সাঈদ ইবনে যুবাইর رحمة الله عليه (মৃ. ৯৫ হিজরী : ৭১৪ খৃস্টাব্দ)

যাঁর প্রস্থানে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় ব্যথিত হয়েছিল। যাঁর অন্তরে ইসলামের গৌরব ও সম্মান জ্বলজ্বল করেছিল। দুনিয়া যাঁর হৃদয়কে মোহিত করতে পারেনি। দুনিয়ায় ইলমের মর্যাদার পাশাপাশি জান্নাতে যাঁর ছিল শাহাদাতের মর্যাদা। যুহদ ও দুনিয়ামুখিতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। বিদগ্ধ আলেমে দ্বীন। হাফেযে হাদীস। বিখ্যাত ক্বারী ও মুফাস্সির। খ্যাতিমান ফকীহ ও ইসলামী আইনজ্ঞ। কান্নাপ্রবণ ব্যক্তি।

তিনি সাঈদ ইবনে যুবাইর। মনিব পরিচয়ে আলআসাদী। আবূ আব্দুল্লাহ্। বিখ্যাত বুযূর্গ তাবেঈ। তাকওয়া ও পরহেযগারের জগতে একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। প্রধান ও নামকরা সাহাবা কেরাম থেকে ইলম ও জ্ঞান লাভ করেছিলেন। আবিসিনিয়া বংশোদ্ভূতত। বিদ্বান ব্যক্তি। অন্যতম বুযূর্গ আলেমে দ্বীন। অপ্রতিন্দ্বন্দ্বী সেরা বিদ্বান তাবেঈ হিসেবে যিনি সুপরিচিত। কাউকে নিজের সামনে গীবত করতে দিতেন না। যাঁর সব দোআ-ই কবুল হতো। তিনি ছিলেন একটি বাতিঘর। যে চেরাগের জ্যোতিতে সন্দেহ-সংশয়ের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। নীরবতায় চোখের পানি ঝরতো। উমাইয়া জালিম শাসক হাজ্জাজের বিরুদ্ধাচরণকারীদের তিনি একজন ছিলেন। বিদ্রোহী অন্যান্য বন্ধুরা পরাস্ত হলে তিনি মক্কা শরীফে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানের প্রশাসক তাঁকে গ্রেফতার করে হাজ্জাজের নিকট প্রেরণ করলে সে তাঁকে হত্যা করে।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. সম্পর্কে বলেন, হাজ্জাজ সাঈদ রহ.কে হত্যা করলো। অথচ ভূ-পৃষ্ঠে এমন কোন ব্যক্তি নেই যে সাঈদের ইলমের দিকে মুখাপেক্ষী নয়। তিনি যখন নামাযে দাঁড়াতেন মনে হতো কোন স্থির ও স্তব্ধ কীলক। বছরে দু’বার বের হতেন। একবার হজ্ব করার উদ্দেশ্যে। আরেকবার উমরার উদ্দেশ্যে। বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করতেন। একবার কা’বা শরীফের ভেতরে প্রবেশ করলেন। এক রাকাতে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করলেন।

তিনি বলেছেন, তোমাকে আল্লাহ তাআলা হালাল রিযিক দান করেছেন আর তুমি তা তাঁর গুনাহ ও নাফরমানিতে খরচ করলে। এটাও সম্পদ নষ্ট করার শামিল। অতিশয় অনুভূতিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। সংবেদনশীল এই ব্যক্তির চোখের পানি শুকাতো না। সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. এর কান্না সম্পর্কে আ’রাজ বর্ণনা দিচ্ছেন, সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. রাতের বেলায় বেশি বেশি কাঁদতে কাঁদতে তিনি রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কখনও কখনও এমনও হতো, তাঁর ছাত্ররা তাঁর কাছে এসো দেখতো যিনি কান্নায় ব্যাকুল। তা দেখে তারা কান্না জুড়ে দিতো।

তিনি তাঁর মায়ের বাধ্যগত সন্তান ছিলেন। কখনও মায়ের কোন হুকুমের লঙ্ঘন করতেন না। একবার তাঁকে বিচ্ছু দংশন করলো। তখন তাঁর মা কসম খেয়ে বললেন, আমি তোমার তদবির করবো। ঝাড়ফুঁক যা লাগে আমিই করবো। কিন্তু যখন কবিরাজ আসলো তিনি তাকে অন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। যাতে নিজের মায়ের কসম ভেঙে না যায়।

একদিন তাঁকে এক পেয়ালা মধু দেয়া হল। তিনি তা নিয়ে শুধু এক ঢোঁক পান করলেন। বললেন, কসম, এক ঢোঁক সম্পর্কেও আমি জিজ্ঞাসিত হবো। তিনি এই দুনিয়া সম্পর্কে খুব ছোট আশাবাদী ছিলেন। যার ইবনে আব্দুল্লাহকে উপদেশ দিতে গিয়ে লিখেছেন যে, মুমিনের যাপিত প্রতিটি দিন অনেক সৌভাগের। দুনিয়া হল আখেরাতের কতগুলো হপ্তাহের একটি হপ্তা। সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. ও মৃত্যুস্মরণ একে অপরের নিত্যসঙ্গী ও বন্ধু ছিলেন। কখনও ছিন্ন হতো না তাদের এই বন্ধুত্ব। তিনি সর্বদা আওড়াতেন, মৃত্যুস্মরণ যদি আমার অন্তর থেকে আলাদা হয়ে যায় আমার আশঙ্কা তা নষ্ট হয়ে যাবে।

যখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ গ্রেফতার করলেন সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ.কে তখন তিনি বললেন, আমার কাছে মনে হয় আমাকে হত্যা করা হবে। এরপর অনেক কথা বললেন। আমি ও আমার অন্য সঙ্গীরা দোআ করতাম। দোআর মজা ও স্বাদ অনুভূত হওয়ার পর আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে শাহাদাতের মর্যাদা চেয়েছি। অন্য বন্ধুরা শাহাদাতের মর্যাদা পেয়েছে। আমি সেই শাহাদাতের মর্যাদা পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।

যখন হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. কে হত্যা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয় তখন তিনি নিজের ছেলেকে ডাকলেন। ছেলে কাঁদছে। তিনি ছেলেকে বললেন, কেন কাঁদছো? সাতান্ন বছর পর তোমার বাবা বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। যখন তিনি হাজ্জাজের সামনে দাঁড়ালেন, হাজ্জাজ নির্দেশ দিলো তাঁকে হত্যা কর। হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় হাসলেন। হাজ্জাজকে হাসির কথা জানানো হল। হাজ্জাজ বললো, তাঁকে ফেরত নিয়ে এসো। বলল, কেন তুমি হাসলে? হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ. বললেন, আমি অবাক হলাম আল্লাহ তাআলার প্রতি তোমার স্পর্ধা ও দুঃসাহস দেখানো আর তোমার প্রতি আল্লাহ তাআলার ধৈর্যের প্রদর্শনের জন্য। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আমাকে হত্যা করার পর আর কাউকে যেন হাজ্জাজ হত্যা করার সুযোগ না পায়। তার কর্তৃত্ব শেষ করে দাও। এরপর চামড়ার একটি কার্পেটে রেখে হযরত সাঈদ ইবনে যুবাইর রহ.কে শহীদ করা হয়। শাহাদাতের কয়েক দিন পর হাজ্জাজ মারা যায়।