পারিবারিক জীবন যেন শান্তিময় ও স্থিতিশীল থাকে সেজন্য কর্তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এক তো হল, কর্তা সতর্ক থাকেন, যার জন্য তার পরিবার বড় ধরণের প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা পায়। আরেক হল, পরিবারে যদি কোনো কারণে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়, কর্তা আগে দেখেন, এর সূত্রপাত কোথায়? দ্বীনদার, বিচক্ষণ ও সতর্ক কর্তা সবরের সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতির মুকাবিলা করে থাকেন, মাশাআল্লাহ।
যদি এমন হয় যে, কোনো সমস্যা দেখা দিলে পরিবারের কর্তা তৎক্ষণাৎ সরাসরি অধীনস্থ কাউকে দোষারোপ করে বসেন। তখন স্বাভাবিকভাবে যেটা হয় – পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। বাকবিতন্ডা এমনকি ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়।
আমরা তো অবশ্যই শান্তিপ্রিয়। তাহলে কি আমরা কেবল শাসন বা দোষারোপ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার সমাধান খুঁজব? এমনটা করার কারণে অধিকাংশ সময় একজন কর্তা ইনসাফ (ন্যায় বিচার) করতে পারেন না। দেখা যায়, কর্তা যখন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক বার পরিবারের কারুর বিপক্ষে তাৎক্ষণিক ফয়সালা করেন, তার মন ভাঙে। পরিবারের সংশ্লিষ্ট সদস্য, তিনি স্ত্রী হন, বা হোক কোনো সন্তান – তার অন্তর কষ্টে টুকরো টুকরো হয়। নিজেকে সে বঞ্চিত মনে করে।
কর্তাকে আরও ধীর-স্থিরভাবে চিন্তা করে কাজ করতে হয়। তাহলেই পরিবারের সদস্যদের মন জয় করে সুখ-শান্তি বজায় রাখা সহজ হয়ে থাকে।
আমি পরিবারের একজন কর্তা। আমি আল্লাহ তাআলার শেখানো এমন দোআ করছি:
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।[সূরা ফুরক্বান ২৫:৭৪]
চিন্তা করুন! অথচ আমার মাধ্যমে আমার স্ত্রী ও সন্তানের উপর যদি জুলুম হয়, সেটা কত দুঃখজনক!
শাসন করার অধিকার আছে, দোষীকে দোষারোপও করা যাবে, অন্যায় করে থাকলে কাউকে সতর্ক করা, প্রয়োজনে লঘু শাস্তিও দেওয়া জরুরি – আপন স্থানে সবই করতে হবে; কর্তা হিসেবে আমি করবও। কিন্তু আমার পদ্ধতিটি কেমন হলে সেই শাসন, সতর্কতা ও সংশোধনের ইতিবাচক সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে? সেভাবেই তো পদক্ষেপ নিতে হবে!
যদি আমি না-ই জানি যে কিভাবে পরিবারের কারো অন্যায়ের বিপরীতে শাসন করতে হয় অথবা কিভাবে পারিবারিক কলহ-দ্বন্দ্ব নিরসন করতে হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমি গোড়াতে ভুল করব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একজন কর্তা হয়ে আমি বরং নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত – কখন কী করা উচিত(!)
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মান-মর্যাদা, অবস্থান, ব্যক্তিত্ব আছে। আর সেই হিসেবে প্রত্যেকের নিজ অধিকার রয়েছে। পরিবারের কর্তা হিসেবে এ কথা যেমন আমাকে জানতে ও স্মরণ রাখতে হবে, তেমনই আমাকে তা মূল্যায়ন করতে হবে। যদি কখনও এমন হয় যে, কোনো বিবাদ নিরসন করতে গিয়ে আমার সামনে একজনের অধিকারই বড় বলে মনে হয়, আর তার কারণে আমি আরেকজনকে বেশি শাসন করে ফেলি – এমন হওয়ার আশংকা থাকে যে, আমি দ্বিতীয় জনের অধিকারের অবমূল্যায়ন করে তার উপর জুলুম করে ফেলি! একজনের অধিকার রক্ষা করার অর্থ যদি আরেকজনের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয় – এটা স্পষ্ট অন্যায়। অথবা এভাবে বুঝুন:
কাউকে খুশি করতে গিয়ে আরেকজনের মনে কষ্ট দিচ্ছি। সন্তানদের অধিকার আদায়ে হোক কিংবা স্ত্রীর, আর সেটা যে কারো বিপরীতে হোক – পরিবারের কর্তার লক্ষ রাখতে হবে, আমি যেকোনো সমাধানের সময় ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করব। যার দোষ আছে তাকে শাসন করা মানে তাকে অপমান করা নয়, বরং তাকে সংশোধন করা। সংশোধন যদি এমন পন্থায় হয় যে পন্থায় করলে আমি বেশি রেগে যাই, বা তার বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় আচরণ করে বসি, বা আমার আচরণে সে অপমানবোধ করে, আমাকে বুঝতে হবে, সেটার মাধ্যমে তার সুদূরপ্রসারী কোনো সংশোধন হবে না। এটা আমরা যেন ভুলে না যাই। প্রতিটি কাজের একাধিক ধারা ও পদ্ধতি রয়েছে। আমাকে চিন্তা করে উত্তম পদ্ধতিটি নির্বাচন করতে হবে!
অনেক সময় নিজ মায়ের হক আদায় করার উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে এমন কিছু বলি বা তাকে আদেশ করে বসি যা আমার স্ত্রী পছন্দ করেন না। অনেক কর্তাগণই এ কাজটি নেক নিয়তে করে থাকে। পদ্ধতি সঠিক না হওয়ার কারণে এমনকি স্ত্রীকে দেওয়া ফরমায়েশ ও আদেশ সঠিক না হওয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। মাকে খুশি করা কি কোনো মন্দ কাজ? নিঃসন্দেহে নয়। কিন্তু আমার মাকে আমি খুশি করার জন্য স্ত্রীকে আমি যে আদেশ বা নিষেধ যা-ই করছি সেটা কখন কোন্ পদ্ধতিতে হচ্ছে সে ব্যাপারে আমি সজাগ না হলে কিন্তু মাকে খুশি করে স্ত্রীকে হয়ত কষ্ট দিয়ে দেব। এটা যে সবসময় ও সবক্ষেত্রেই অনুচিত তা নয়। কিন্তু যেক্ষেত্রে মা ও স্ত্রীকে মুখোমুখি না করা যায়, কেন আমরা সেক্ষেত্রে মা ও স্ত্রীকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিই?!
মা ও স্ত্রীর মধ্যে যে অদৃশ্য দ্বন্দ্ব অনেক সময় অন্য কারণে হয়ে থাকে, আমি তো আমার আচরণের মাধ্যমে তাতে আরেকটু জ্বালানিই সরবরাহ করলাম! আহা, ভালো করতে গিয়ে খারাপ হল! আসলে সব ভালো সবসময় করাটাও অনুচিত – এ শিক্ষাটি আমাদের জানা উচিত। মাকে খুশি করার জন্য আমার কখন, কী, কিভাবে তা করণীয় – সেটা না বোঝার কারণেই স্ত্রী ও মায়ের মধ্যে আমি নিজেই দূরত্ব তৈরির পথ করে দিচ্ছি। আগে তো কিছু অভ্যন্তরীণ দূরত্ব ছিল, এখন আমার কিছু কাজের কারণে সেটা বাহ্যিক দূরত্বের রূপ নিচ্ছে!
মা ও স্ত্রীকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানোর কাজ কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তির দ্বারা হয় না! বউ ও শাশুড়ি এমনিতেই নানাভাবে সংসারে মুখোমুখি হয়ে যান! তখন ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু আমি স্বামী হয়ে যেন এমন কোনো কিছু না করি যার কারণে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরুর সামান্য উপলক্ষ তৈরি হয়ে যায়!
অনেকেই স্ত্রীকে এমন সময়ে এমন আদেশ করে থাকে যার ফলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ও আন্তরিকতার জায়গাটিতে ঘাটতি দেখা দেয়। বোঝানো এটাই উদ্দেশ্য যে, যে কাজের আদেশ করা হচ্ছে, কাজটি ভালো হওয়া যথেষ্ট নয়। আদেশ বা উপদেশের পদ্ধতিও সঠিক হতে হবে। তাহলে দেখবেন একজন কর্তা হয়েও আমি-আপনি কত ভালো কাজ আদায় করে নিতে পারব ইনশাআল্লাহ!
একটি উদাহরণ হল, স্ত্রীকে দশবারের মধ্যে একবার বলা দেখ তো মায়ের কী লাগবে, আর বাকি নয়বার স্ত্রীর সামনে নিজেই মাকে জিজ্ঞেস করা মা তোমার কী লাগবে আর সেই অনুযায়ী ছেলে নিজেই কাজটি করা। দেখবেন স্ত্রী আপনার সুবিধা ও সাহায্যের জন্য হলেও আপনার মায়ের ঐ বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু তাকে একই বিষয়ের আদেশ দিতে থাকলে সেটা তার মধ্যে তিক্ততাই বাড়াবে।
মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, সম্মান ও অধিকার নিয়ে কি কোনো সংশয় আছে?! থাকতেই পারে না। মায়ের ঋণ কখনো পরিশোধযোগ্য নয়। এটিও অনস্বীকার্য! সঙ্গে একজন বিবাহিত পুরুষকে এটিও জানতে ও মানতে হবে যে, স্ত্রীর প্রতি তার অধিকার রয়েছে। স্ত্রীরও তার নিজ স্বামীর ভালোবাসা প্রাপ্য। আল্লাহ তাআলা স্ত্রীকে স্বামীর বিপরীতে স্ত্রীর অবস্থানে সম্মানও দান করেছেন। কারোর ভালোবাসা, সম্মান ও অধিকারের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। তুলনাও অনুচিত। বরং, সবার প্রাপ্য সবাইকে দিতে হবে। অন্তত সুষ্ঠুভাবে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। কেউ কারো অধিকার, ভালোবাসা ও সম্মান আদায়ে যেমন অন্যের অধিকার, ভালোবাসা ও সম্মান ক্ষুণ্ন করতে পারে না, স্বামীও তার নিজ মা ও স্ত্রীর ক্ষেত্রে এগুলো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারসাম্য রক্ষায় এমনভাবে সচেষ্ট থাকেন যেন একজনের কারণে আরেকজনের উপর জুলুম না হয়। এটি কিছু কারণে কঠিন। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে এটি অসম্ভব। আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর অসম্ভব কিছু চাপাননি। আর কঠিন কিছুও তিনি চাপাননি। আমাদের নিজেদের প্রচলিত নানান সামাজিক রীতি, মানসিকতা ইত্যাদির কারণে আমরা এটি কঠিন করেছি অথবা আমাদের কাছে তা কঠিন বোধ হচ্ছে!
শরীয়তের অনুগত থেকে, বিবেক ও বুদ্ধি প্রয়োগ করে দৈনন্দিন জীবনের কত রকম সমস্যা আমরা সমাধান করি! কখনো সাধারণ একটু কথা ইখলাসের সঙ্গে বলার মাধ্যমে, উভয় পক্ষকে নিয়ে বসে আলোচনার মাধ্যম অথবা উভয় পক্ষকে পৃথকভাবে কিছু বলে আমরা পুরুষেরা অফিস-আদালতে, পথে-ঘাটে, দোকানপাটে কত ধরণের সমস্যার সমাধান করি?!
কিন্তু পারিবারিক জীবনে অধিকাংশ পুরুষ বা কর্তাগণ তাৎক্ষণিক কিছু আচরণ, শাসন ও পদ্ধতি অবলম্বন করে তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন! ফলে সমস্যার উদ্ভব হয়, কখনো পূর্ব থেকে সৃষ্ট সমস্যা কর্তার ভুল পদক্ষেপের কারণে আরও বাড়ে! বাড়িতে কর্তাগণ চিন্তা করে কাজ না করার কারণেই নানান বিব্রতকর, এমননি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়! শুরুতেই বলা হয়েছে, অন্যতম হল, কর্তাদের অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে কোনো পক্ষ অবলম্বন করে ফয়সালা করে ফেলি! এর কারণ খতিয়ে দেখলে অবশ্য বোঝা যায়, অন্যতম কারণ হল, “সামাজিক চাপ”। যা নিতান্তই দুঃখজনক।
উলামায়েকেরাম বলেন, কেবল বিয়ে সুন্নাহ পদ্ধতিতে করে ক্ষান্ত হওয়া অনুচিত। সেটির সঙ্গে আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, সুন্নাহ পদ্ধতিতে সংসার করা, পারিবারিক বিষয়াদি সেভাবেই দেখভাল করা। বিভিন্ন পারিবারিক পরিস্থিতিতে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করা ও সমস্যা নিরসনে সুন্নাহসম্মত পন্থা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।
একজন কর্তার বিচক্ষণতার ওপর গোটা একটি পরিবারের শান্তি ও সম্প্রীতি নির্ভর করে। কর্তাকে আল্লাহ তাআলা পরিবারের ইমাম হিসেবে নিযুক্ত করেই দিয়েছেন (সূরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াতের দোআটির তাফসীর দ্রষ্টব্য)! এখন ইমাম যদি নিজেই উত্তম নমুনা হতে পারেন, তাহলে সংসারে শান্তি আসবে কি আসবে না?! ইনশাআল্লাহ আসবে।