ঈমান ও আক্বীদাচিন্তার খোরাক​

মৃত্যু প্রতিরোধের চেষ্টা!? – ২

এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাঝে ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

একজন মুসলমানের জন্য বিশ্বাসের দিকটি ঠিক রাখার সঙ্গে কর্মগত দিকটিও ঠিক রাখতে হবে। আমাদের ভরসাস্থল আল্লাহ তাআলাই, এটিই আমাদের বিশ্বাস। কর্মগতভাবেও এর বহিঃপ্রকাশ থাকবে। মুখে বলা যে, আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি — এটা তো সহজ! কাজে ও প্রচেষ্টায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। সুন্নাহই হল মধ্যমপন্থা!

উলামায়েকেরাম বলেন, অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা গ্রহণ জরুরি। যার যতটুকু সাধ্য ও সামর্থ্য সে ততটুকু চিকিৎসা গ্রহণ করবে।

আমাদের যুগ তো আই. সি. ইউ, আর সি. সি. ইউ’র যুগ! বাঁচার জন্য এ জায়গাগুলোকে কত না বড় আশ্রয়স্থল মনে করা হয়?! আমরা বাঁচতে চাই কিন্তু এমন বাঁচা যার থেকে আল্লাহ তাআলার আশ্রয় গ্রহণ জরুরি। কিন্তু আমাদের চাওয়া-পাওয়ার ধরণ হয়ে গেছে উল্টো। আমরা যে বলি, আরামে-শান্তিতে বাঁচাতে চাই — এটা কেবল মৌখিক এক আবদার ও দাবি যেন। কাজে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত। এমন পথ ও পন্থা অবলম্বন করি যে পথে বেঁচে কোনো শান্তি নেই!

সাধ্য সামর্থ্যের বাইরে চিকিৎসার কথাই ধরুন। অহরহ সাধ্যের বাইরের পথ অবলম্বন করি আমরা। তাতে আমাদের কষ্টেরও যেন সীমা থাকে না! তবু আমরা বলি, “আল্লাহ চেষ্টা করতে বলেছেন”। এ জাতীয় কথা বলে কি আমরা নিজ অন্যায় আল্লাহ পাকের ওপর চাপাতে চাই?!! আল্লাহ তাআলা কি আমাদেরকে সীমার বাইরে চেষ্টা করতে বলেছেন?! নাউযুবিল্লাহ, কখনো নয়।

এভাবে রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসার জন্য যত পথ আমরা অবলম্বন করি তার অনেক কিছু আমাদের মন গড়া, আবেগপ্রসূত ও বাস্তবতা বিমুখ। আমাদের প্রচেষ্টা ভুল পথ ও ধারায় প্রবাহিত। না জাগতিক মাপকাঠিতে এমনভাবে চলা উচিত, না শরীয়তের বিধানের ভিত্তিতে!

ডাকতারগণকে দায়ী করার যৌক্তিক অবস্থা থাকতে পারে। কিন্তু আগে নিজেদের অবস্থা যাচাই করা উচিত। আমরা যেমন আচরণ করে থাকি, আমাদের ডাকতারগণও আমাদের সাথে তেমন আচরণ করেন। অন্তত আমাদের কিছু প্রভাব তো পড়েই তাদের ওপর!

আমরা রোগ নিরাময়ে অস্থির হয়ে পড়ি। ওষুধ, ডাকতার ও হাসপাতালসমূকে আমরা এমন আশ্রয় বলে বিশ্বাস করি যে মুসলমান আর অমুসলমানের মধ্যে পার্থক্য বোঝা মুশকিল হয়ে যায়! মুসলমান যদি কাজে কর্মে অমুসলমানদের মতন অস্থির হয়ে পড়ে, তাহলে সে কেমন মুসলমান?!

রোগে শোকে কি অস্থির-ব্যাকুল হওয়া যাবে না? অবশ্যই যাবে। এ কথা বলা উদ্দেশ্য নয় যে, আমরা রোগে-শোকে কাতর হব না। বরং বান্দা কষ্টে কাতর হওয়াটি তো বন্দেগীর বহিঃপ্রকাশ। বলা হচ্ছে যে, আমাদের আচরণ ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।

এই যে মৃত্যুকে এতটা পর মনে করা এবং তা থেকে এমনভাবে বিমুখ হওয়া যেমন কাফেররা, এটা তো মুমিনের শান নয়। এই যে চিকিৎসা করানোর ক্ষেত্রে এমন বাড়াবাড়ি ও এমন জাতীয় কথাও বলা যাতে আল্লাহ তাআলা নারাজ হন, এটা তো মুমিনের শান হতে পারে না! সুস্থ হোক বা অসুস্থ, মুমিন তো আল্লাহ তাআলার ধ্যান ও যিকিরে এমনভাবেই থাকবে যে সে আল্লাহর বান্দা! ডাকতার দেখানো নিষেধ নয়, ওষুধ ব্যবহার নিষেধ নয়, হাসপাতালে দৌঁড়ানো নিষেধ নয়, কিন্তু এসবের কোনোটি যখন আমাকে আল্লাহ তাআলার ধ্যান খেয়াল থেকে দূরে রাখে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও তাঁর কাছে বিনয়াবনত হয়ে চাওয়া থেকে বিরত রাখে, দুনিয়াতে শুধু বাঁচার ফিকিরে আমি পাগলপারা হই — এ হল আফসোসের বিষয়!

কখনো এমন হয় যে, রোগীও যত না অস্থির তার চেয়েও তার আত্মীয়স্বজন অনেক বেশি অস্থির হয়ে ওঠে। ইসলাম মুসলমানকে এ কথাই বলে যে, তোমার স্থিরতা আর অস্থিরতা — যত অবস্থাই আছে — সবকিছুরই একটি সীমা রয়েছে।

সবক্ষেত্রে মুসলমান যেমন সতর্ক ও আল্লাহ-মুখী, এক্ষেত্রেও তাই। বিশ্বাস ও কর্মগত — উভয়দিকে তাকে ভারসাম্যপূর্ণ থাকতে হবে। তখনই আমরা সীমার মাঝে থাকতে পারব। এ পথেই শান্তি ও সমৃদ্ধি!

নানান অবস্থা যখন আসে, আমাদের ঈমান ও আমলের প্রকৃত অবস্থা ফুটে ওঠে। পরীক্ষায় পতিত হলে বোঝা যায় আমি আসলে কার বান্দা! অবস্থার বান্দাগণ অবস্থার পূজারী। অবস্থা মন মতন না হলে মহা অস্থির!

মুমিন তো আল্লাহ তাআলার ফয়সালার অপেক্ষায় অপেক্ষমান। রোগবৃদ্ধি অথবা মৃত্যু লেখা থাকলে কার সাধ্য তা ঠেকাবে?! মুমিন খুশি মনে আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। এমনকি মৃত্যুকেও স্বাগত জানায়। তার আত্মীয়-স্বজন কষ্ট পায়, বুক ফেটে কান্না আসে ঠিক, কিন্তু আল্লাহ তাআলার ফয়সালাকে মুমিন মানতে বাধ্য। তারাও সেটি মেনে নিয়ে অশেষ সবরের পুরস্কার পায়! নিকট জনের বিয়োগ ব্যথার ওপরে তারা স্থান দেয় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিকে। এমনই হতে হবে মুমিন-মুসলমানকে!

কবির অভিব্যক্তি বোঝার সামর্থ্য ক’জনের আজ..

বাঁচার আর ভোগের জন্য

হে মুসলমান,

এই দুনিয়া তোমার নয়!

বাঁচ বা মর তাঁর জন্য..

তাঁরই আদেশ সব

তাই তাঁরই শিরোধার্য হতে হয়।

হয়ত বাঁচবে, নয় মরবে — শান্ত হও,

তাঁর সন্তুষ্টি খোঁজো, দৃঢ় হও!

কাফের যেমন বাঁচতে চাবে

তুমি তেমন নও!

তুমি অসুস্থ হলে পবিত্র হও

এটি কত বড় শান!

ধন্য হয়েও আজ ধন্য কি তুমি নও?!

কেবল সুস্থতা চাও! 

হাঁ, সুস্থতা চাও। তবে জেনো

অসুস্থতা খাস রহমত তাঁর

তাই তুমি নত হয়ে যাও!

নত হওয়ার মোক্ষম সুযোগে

নত হও, পবিত্র হয়ে যাও..

এ কল্যাণ মুফতে মিলেছে

মহা শোকরে দু’ হাত পেতে নাও! 

অসুস্থ হয়ে পালায় ভয়ে

মৃত্যু যদি করে গ্রাস–

এতো কাফের ভাবে,

তার তো সর্বনাশ!

মুমিন রোগে শোকে যারা

কেবল পাগলপারা,

তাদের দেখলে বিস্মিত হই

তারা বড়ই অবাক করা!

হে মুমিন! মৃত্যু তব তোফা

এ বিশ্বাসে হও বলীয়ান

ঈমান নিয়ে যে যাবে চলে

দো-জাহানে তারই সম্মান!

Last Updated on March 21, 2023 @ 12:33 pm by IslamInLife

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it