মানুষের চেষ্টা-তদবীর ও এর হাকীকত (বাস্তবতা)
মানুষের চেষ্টা-তদবীর করার যে যোগ্যতা ও ক্ষমতা এটার পরিমাণ ও সীমা আল্লাহ প্রদত্ত। তিনি যতটুকু দিয়েছেন তা-ই। আর সে অনুপাতেই মানুষ আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে (তাঁর আদেশ-নিষেধ) মানতে আদিষ্ট। বিষয়গুলি একদমই সহজ। কিন্তু যার অন্তর ভালো, সুস্থ তার জন্য সহজ। যে ব্যক্তি বক্র চিন্তা করে আল্লাহর ওপর প্রশ্ন উত্থাপন করে (নাউযুবিল্লাহ) সে সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে ধ্বংস হবে (যদি সত্য জানার বা বোঝার পর নিজের ভুল বা সীমালঙ্ঘন থেকে খাঁটিভাবে তওবা করে সেটা ভিন্ন কথা)।
সমগ্র সৃষ্টি ও বস্তুজগৎ তো আল্লাহ তাআলারই নিয়ন্ত্রণে। মানুষ ও জ্বীন জাতিকে যা কিছু এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে তা-ও সীমিত ও পরীক্ষার উদ্দেশ্যে — তাদের কেউ আল্লাহকে মানে, কেউ মানে না।
এখন আমাদেরকে (মানুষকে) যে অসুস্থ হলে ওষুধ খেতে বলা হল, ডাক্তার দেখাতে বলা হল, আরও এমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে চেষ্টা-তদবীর করতে বলা হয়েছে — এসব কিন্তু আল্লাহ তাআলার প্রতি আনীত বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে করতে বলা হয়নি! আর এমন তো নয়ই, বরং প্রশ্নই উঠে না যে, এগুলো (ওষুধ, ডাক্তার অন্যান্য মাধ্যম ও বস্তু)-কে আল্লাহ তাআলা নিজ থেকে কিছু করার স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন, কখনোই এমন নয়। এই বিশ্বাসই প্রতিটি ঈমানদারদের।
আল্লাহ ব্যতীত কারুর কোনো কিছু করার সার্বভৌম শক্তি নেই
কোনো ব্যক্তি, বস্তু ও মাধ্যমের নিজস্ব কাজ করার শক্তি ও ক্ষমতা এ অর্থে নেই যে, তা একচ্ছত্র ইচ্ছায় যেকোনো উপায়ে কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারে। অবশ্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যাকে যতটুকু ক্ষমতা, শক্তি, যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে সেটা সে ব্যবহার করতে পারে। আর ঐসব “ব্যবহার করা”র সঙ্গে মানুষ ও জ্বীনকে ভালো-মন্দ কাজের (এ ভালো-মন্দ — আল্লাহর মাপকাঠিতে যা ভালো ও মন্দ) স্বাধীনতাও দেওয়া হয়েছে কিছু — যার উপর ভিত্তি করেই তাদের পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিষয়টি খুব স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন!
কখনো বলা হচ্ছে সবই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে, আবার বলা হচ্ছে প্রাণী, বস্তু বা মাধ্যমের ক্ষমতা, শক্তি, যোগ্যতা আল্লাহ দিয়েছেন। আবার বলা হচ্ছে মানুষ ও জ্বীনকে কিছু স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সবগুলো কথা আপন জায়গায় সঠিক। এখানে বিভ্রান্তির কিছু নেই। প্রশ্ন শুধু এতটুকু জাগতে পারে: সবই যদি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে হয় তাহলে মানুষ কেন কাজ করে আর চেষ্টা করে?
এটাও আসলে স্পষ্ট। না জানার ও বুঝে না নেওয়ার কারণে আমাদের কেউ কেউ বিভ্রন্তিতে পড়ে থাকে।
আল্লাহ তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখেই পার্থিব জগতের নিয়মকানুন বেঁধে দিয়েছেন। যতটুকু তিনি চেয়েছেন (অর্থাৎ ইচ্ছা করেছেন) মানুষ ও জ্বীনকে ততটুকু এখতিয়ার বা নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী পথ গ্রহণের সামর্থ্য দিয়েছেন। নিয়মকানুন বেঁধে দিয়েও আল্লাহ তাআলা পুরো জগতের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছেই রেখেছেন। এজন্যই কেউ বা কোনোকিছু চাইলেই যখন যা ইচ্ছা করতে পারে না! মানুষ ও জ্বীন আল্লাহ তাআলার বেঁধে দেওয়া নিয়মেই কাজ ও চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু সে কথাটি খেয়াল রাখতে হবে, এর অর্থ কখনো এ নয় যে, ঐ কাজ বা চেষ্টা বা কোনো মাধ্যম, যা কিনা মানুষ গ্রহণ ও অবলম্বন করে — সেগুলির নিজস্ব কোনো ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা আল্লাহরই। যদি কাজ, চেষ্টা ও মাধ্যমে কোনো ক্ষমতা দেখা যায় — সবই আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহর আদেশ মুতাবিক সেগুলি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল। বস্তুর তো মানুষ বা জ্বীনের মতন কোনো এখতিয়ারও নেই! অতএব কত নির্বোধ যারা মূর্তির সামনে মাথা নত করে বলে এটা আমার খোদা(!) তেমনই কত নির্বোধ কোনো ব্যক্তি যদি ডাক্তারকে বলে, “ডাক্তার সাহেব আপনিই পারেন আমার বাচ্চাকে বাঁচাতে!”
অবশ্যই মানুষ কাজ ও চেষ্টা করতে আদিষ্ট। কিন্তু মানুষ কোনো কাজ, চেষ্টা, বস্তু, মাধ্যম, ব্যক্তির উপর এই অর্থে ভরসা রাখতে পারবে না যে, এইসবের কোনোটির নিজস্ব সার্বভৌম কিছু করার ক্ষমতা আছে। যে মানুষ এমনটা বিশ্বাস করে সে আল্লাহর সৃষ্টিকে আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে বসে। এটা স্পষ্টই আল্লাহকে অস্বীকার করা হয় অথবা সে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক সাব্যস্ত করে। সৃষ্টি কিভাবে স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য বা গুণ পায়?! মনে প্রাণে ইচ্ছাকৃত এমন বিশ্বাস করলে কুফুরী হবে, ঐ ব্যক্তি কাফের হবে।
ঈমানদার আল্লাহর আদেশে কাজ করে ও চেষ্টা করে থাকে। তার বিশ্বাস এটাই যে আল্লাহ পাকই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, আদেশ নিষেধ তাঁরই। আমাকে তিনিই আদেশ করেছেন কাজ করতে, বস্তু বা মাধ্যম গ্রহণ করতে, কোনো ব্যক্তির সাহায্য-সুপারিশ নিতে। কিন্তু এসব চেষ্টা ও মাধ্যম আমার মতই আল্লাহর সমপূর্ণ মুখাপেক্ষী। কেউ আমার পক্ষে কাজ করলে সেটাই আল্লাহর দেওয়া শক্তি ও যোগ্যতা ছাড়া করতে পারেনি। কেউ আমার পক্ষে কিছু না করলে বা বিরুদ্ধে করলেও তাকে আল্লাহর এখতিয়ার দেওয়া আছে বলেই সে করতে পেরেছে।




