বর্তমানে মাত্র কয়েকদিনে বাংলাদেশে কয়েক দফা ছোট-ছোট ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হল, গণমাধ্যমের অধিকাংশ ভূমিকম্প সম্পর্কিত সংবাদ, আলোচনা যা করেছে – অধিকাংশ দার্শনিক, সেকুলার ও অমুসিলমদের মতন। সাধারণ জনগণ – আমরাও কতটুকু সচেতন ও সজাগ মুসলমান হতে পারলাম – তাও চিন্তার বিষয়। আমাদের ঈমান, চিন্তা, চেতনা ও কাজগুলো পরখ করে দেখা দরকার। সেজন্য আমরা এই প্রবন্ধটি উপস্থাপন করছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের হক বোঝার তাওফীক দান করুন (আমীন)।
ظَهَرَ ٱلْفَسَادُ فِى ٱلْبَرِّ وَٱلْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِى ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ ٱلَّذِى عَمِلُوا۟ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অর্থ: মানুষের নিজ হাতে কৃত কাজের কারণে স্থলে ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, যেন আল্লাহ তাদেরকে তাদের (মন্দ) কাজের কিছুটা স্বাদ আস্বাদন করান, যাতে তারা তা (সেই গুনাহ) থেকে (সঠিক পথে) ফিরে আসে। সূরা রূম – ৩০: ৪১
সবকিছুর মালিক সুমহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তাঁর কুদরত ও শক্তি অসীম। এ জগৎ তাঁরই অসংখ্য-অগণিত নিদর্শনে পূর্ণ।
দুই শ্রেণির মানুষ
সবকিছু তাঁর ভয়ে সর্বদা ভীত, প্রকম্পিত। কিন্তু মানুষ ও জ্বীন জাতির বিষয় একটু ভিন্ন। কারণ মানুষ ও জ্বীন জাতিকে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে। তাদেরকে এখতিয়ার (choice) দেওয়া হয়েছে। তারা আল্লাহ তাআলাকে মানবে অথবা মানবে না — এই এখতিয়ার তাদের আছে। সেজন্যই মানুষ ও জ্বীন জাতির সবাই আল্লাহ পাকের ওপর ঈমান আনে না। যারা ঈমান আনে তারা সফল হয়ে পুরস্কারের উপযোগী হবে। যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, তারা হবে বিফল, শাস্তির উপযুক্ত।
ভূমিকম্প হওয়ার পরও মানুষের মাঝে দুই শ্রেণি: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও আল্লাহকে অস্বীকারকারী, অবিশ্বাসী। এ দুই পক্ষের চিন্তা ও কর্মে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য।
যুগে যুগে কত বিপদ, দুর্যোগ ও সমস্যা পৃথিবীতে এসেছে — দুই রকম মানুষের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ছিল। আজও তেমনই হচ্ছে। কালের পরিক্রমায় এমনই হবে, এর ব্যতিক্রম হবে না।
শুধু ভূমিকম্প নয়, যেকোনো প্রতিকূলতা, রোগ-শোক, বালা-মুসিবত, মহামারী — ব্যক্তির উপর আপতিত হোক কিংবা অঞ্চল-গোষ্ঠির উপর, সব ব্যাপারেই মুসলমানদের মনোভাব, প্রভাব, প্রতিক্রিয়া মূলত একই — আমাদের গুনাহর কারণে আমরা আক্রান্ত। তারা এ কথাই বলবে: তওবা-ইস্তেগফার, দোআ, পরস্পরের প্রতি উত্তম ব্যবহার, লেনদেনে পরিশুদ্ধি, সৎ কাজে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। এসবের সংশোধান হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ, এগুলো পালনে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন। না পালনে তিনি হবেন অসন্তুষ্ট।
আযাব-গযব আসে আল্লাহ আদেশে, তাঁর অসন্তুষ্টির ফলে, আর আমাদেরকে সতর্ক করার জন্যেও যে, পরকালের আযাব বহুগুণ যন্ত্রণাদায়ক। এ বিশ্বাস থাকার কারণেই বিপদাপদে আল্লাহ-মুখী হয়ে আল্লাহর পথের প্রচেষ্টাগুলো মুমিন তাজা করে নেয়।
আর এর বিপরীতে আল্লাহকে অস্বীকারকারী ব্যক্তি তথা কাফের আল্লাহ থেকে সম্পূর্ণ বেপরোয়া থাকে। সে সব ধরণের বালা-মুসিবত আর প্রতিকূলতায় বস্তু জগতের দিকে দৃষ্টি রাখে। পূর্ণ শক্তি দিয়ে বস্তুর আশ্রয় গ্রহণ করে। সাবধানতা অবলম্বন করে এমনভাবে যে, এইসব বস্তু অথবা মাধ্যমই বাঁচা-মরার মূল উপায় ও মাধ্যম। কেমন যেন তাদের বিশ্বাস হল, বস্তুর সঠিক ব্যবহার ও অবলম্বনই ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে, ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচাতে পারে — বস্তুর যেন সেই শক্তি বা ক্ষমতা রয়েছে!!
যদি বস্তুর শক্তিকেই কেউ অস্বীকার করে তাহলে তো খোদায়ী শক্তিকেই স্বীকার করতে হবে। কাফেরদের বিশ্বাস থাকে পরিপূর্ণভাবে বস্তুর উপর অথবা কিছু বস্তুর উপর এবং কিছু তাদের নিজ হাতে তৈরি বা কল্পিত খোদার উপর!
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
প্রশ্ন হল, বিপদ থেকে বাঁচার পথ সন্ধানে বস্তু তো মুসলমানরাও অবলম্বন করে। মুসলমানরা “আল্লাহই সব করে” বলে আবার বস্তু অবলম্বন করে কেন?
ভূমিকম্প পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরাও তো দৌঁড়ে বাসা থেকে বের হয়ে থাকে, তাদেরও চিন্তা যে বিল্ডিং মজবুত করে নির্মাণ করা দরকার..ইত্যাদি। তাহলে মুসলমান ও কাফের-এর বিশ্বাসে আবার পার্থক্য থাকল কোথায়?
আজকের প্রবন্ধে এটি কিছুটা আলোকপাত করার ইচ্ছা। আর এটা মূলত এজন্য, একজন মুসলমান যেন বুঝে নেয় তার বিশ্বাস ও কাজ একজন কাফের-এর বিশ্বাস ও কাজ থেকে ভিন্ন। যদিও উভয়ের “কাজ”-এর বাহ্যিক অবস্থা প্রায়ই দেখতে একরকম, তবু কাজেও উভয় দলের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে। আর এটা একজন সচেতন মুমিন জানে ও মানে, উপলব্ধি করে থাকে স্পষ্টভাবে। এটা খুবই দুঃখজনক ও আশংকাজনক হবে যে, কোনো মুসলমান কেবল মৌখিকভাবেই ঈমান এনে সন্তুষ্ট থাকে। তার কাজ বা আমলে ঈমানের কিছুই প্রতিফলিত হয় না। ঈমান সাধারণভাবে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়। আর ঈমান প্রকাশ পায় নেক আমলের মাধ্যমে। যদি কারুর নাম মুসলমানের মতনই হয় কিন্তু তার কাজকর্মে ঈমানের প্রমাণ পাওয়া না যায় তার ঈমান শংকাজনক। আর ঈমান পরিপন্থী কাজ পাওয়া গেলে তো স্পষ্ট হয়ে উঠে সে আদৌ ঈমানদারই নয়।
ঈমানদার হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হল, আল্লাহ তাআলাকে এমনভাবে রব স্বীকার ও বিশ্বাস করা যেন তাঁর সার্বভৌমত্ব পরিপূর্ণভাবে স্বীকার ও বিশ্বাস করা হয়। সব কাজে তাঁকেই, অর্থাৎ এককভাবে শুধুমাত্র এক আল্লাহকেই হুকুমদাতা ও ফলদাতা স্বীকার ও বিশ্বাস করতে হবে। কোনো বস্তু বা মাধ্যম ও ঘটনা এমন নেই যা আল্লাহর সৃষ্টিজগতের বাইরে এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে — এ কথাকে পুরোপুরি একজন মুমিন বিশ্বাস করে থাকে — এখানে সন্দেহের সামান্যতম লেশ থাকতে পারবে না। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর বিশেষ বান্দা তথা নবী রাসূলগণের মাধ্যমে যা বলেছেন সেগুলোকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। সেই হিসেবে, সৃষ্টিজগতের কোনো সৃষ্টি, সেটা হোক জীব বা জড়, মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী অথবা বস্তু, এদের কারুর এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই যা আল্লাহ তাআলা তাদের এখতিয়ার বা ক্ষমতা দেননি অথবা আল্লাহ চান না। সহজ কথায়, মানুষ বা যেকোনো সৃষ্টি চাইলেই যা কিছু করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যেমন সবকিছু করতে সক্ষম, তিনি যখন যা ইচ্ছা করতে পারেন, করেনও — সবকিছুর ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য কেবল ও কেবলমাত্র তাঁর। একজন ঈমানদারের কাজগুলো পুরোপুরি এই বিশ্বাসের অনুগামী বা কম-সে-কম সে ঈমান পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত তো অবশ্যই। গুনাহ থেকে তওবাকারী ব্যক্তিও বিরতদের শামিল। তওবাও এমন একটি কাজ যা একমাত্র ঈমানদারই করতে সক্ষম! কোনো গুনাহকে গুনাহ বলে স্বীকার করা তো ঈমানদারের পক্ষেই সম্ভব।




