সাইয়্যেদুনা দাঊদ আলাইহিস সালাম

আল্লাহ তাআলা তাঁকে একাধারে নবুওতী ও রাজত্ব দান করেছিলেন। তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন হেকমত-প্রজ্ঞা ও বাগ্মিতা। যে নবীর সাথে তাসবীহ পাঠ করতো পক্ষীকুল ও পর্বতশ্রেণি। মানবকুলের মাঝে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী। বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের মাঝে মহান আল্লাহ তাঁকে মনোনীত করেছিলেন উদ্ধত জালিম জালূতকে পরাস্ত করার জন্য। তিনি এই জালিমের জীবন লীলা সাঙ্গ করিয়েছিলেন হযরত দাঊদ আ.-এর হাতে। তিনি অকুতোভয় অসম সাহসী বীর। রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাননি কখনও। তরবারির ঝনঝনানিতে ভড়কে যাননি কভু।

আল্লাহ তাআলা তাঁকে দিয়েছিলেন রাজত্ব ও নবুওতি। তিনি যুগপৎ নবী ও সম্রাট। লৌহবর্মের শিল্প তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন। লোহা তাঁর হাতে নরম হয়ে যেতো। তিনি তাঁকে যাবূর গ্রন্থ দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। তাঁকে দিয়েছিলেন অপূর্ব কোমল কণ্ঠস্বর। তাঁর আগে আর কাউকে তা দেয়া হয়নি। সুললিত কণ্ঠেস্বরে তিনি ছিলেন অভূতপূর্ব ও অতুলনীয়। তাঁর আওয়াজ শোনে যে কেউ অনুরণিত হয়ে যেতো। মনের অজান্তে দোল খেত, আন্দোলিত হতো। হয়তো নৃত্যের একটা আবেশ-ভাবাবেগের ঢেউ লাগতো হৃদয়জুড়ে। তিনি যখন যাবূর তেলাওয়াত করতেন মানব-দানব, পশু-পক্ষী সবকিছু তাঁর আওয়াজে নিথর হয়ে যেতো। তিনি ছিলেন যুহ্দ-দুনিয়া বিমুখিতা ও নামায-রোযার মূর্তপ্রতীক।

বড় ইবাদতগুজার। আবেদ ও মুত্তাকী। বিনয়ী ও ভাবাবেগে কাতর। জিহ্বা থেকে কখনও আল্লাহ-এর যিকির আলাদা হতো না। মুখে লেগে থাকতো মাবুদের যিকির। স্মরণ করতেন তাঁকে প্রতিনিয়ত। মুখমণ্ডল জুড়ে লেপ্টে থাকতো কস্তূরি-মাখা আলোর ঝলকানি। কী যে শোভা! কী যে সৌরভ! সর্বদা প্রতিপালকের নেয়ামতরাজি প্রকাশ করতেন নানাভাবে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে দিয়েছিলেন ললিত সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর। সাবলীলভাবে চলতো তাসবীহ পাঠ তাঁর জবানে। অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে যাবূর খতম করতে পারতেন। তেলাওয়াতে প্রাণ ও সময় প্রাচুর্য ছিল প্রচুর। তাঁর কণ্ঠ তেলাওয়াতে আল্লাহ তাআলা রেখেছিলেন এক অপূর্ব হেদায়েত ও উপদেশ-অনুরাগ। ছড়িয়ে পড়তো গভীর ভাবাবেগের এক আবহ। তিনি যখন আল্লাহ তাআলার যিকির ও স্মরণে উচ্চারণ-ধ্বনি নিয়ে জিভ আন্দোলিত করতেন কেমন যেন হৃদয়ের তন্ত্রীতে ধ্বণিত করছেন।

মহান আল্লাহ তাআলা পর্বতমালাকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। সকাল-সন্ধ্যায় তারাও তাঁর সাথে তাসবীহ পাঠ করতো। তারাও বসতো তাঁর যিকিরের আসরে। পাখপাখালি তাঁর কাছে জড়ো হতো। তাঁর তাসবীহ পাঠে তারাও সুর মেলাতো। তাঁর তেলাওয়াত ধ্বনিতে তারাও প্রতিধ্বনিত করতো। পরবর্তী লোকজনের জন্য তাঁর ইবাদত একটি আদর্শ। তাই তাঁর নামায শ্রেষ্ঠ নামায। তাঁর রোযা শ্রেষ্ঠ রোযা। সালাত ও সিয়ামে তিনি এক অনুকরণীয় আদর্শ।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ বলেছেন :
أَحَبُّ الصَّلَاةِ إِلَى اللَّهِ صَلَاةُ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلَام وَأَحَبُّ الصِّيَامِ إِلَى اللَّهِ صِيَامُ دَاوُدَ وَكَانَ يَنَامُ نِصْفَ اللَّيْلِ وَيَقُومُ ثُلُثَهُ وَيَنَامُ سُدُسَهُ وَيَصُومُ يَوْمًا وَيُفْطِرُ يَوْمًا.

আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক প্রিয় নামায হযরত দাঊদ আ.-এর নামায এবং সর্বাধিক পছন্দনীয় রোযা দাঊদ আ.-এর রোযা। তিনি অর্ধরাত ঘুমাতেন, এক-তৃতীয়াংশ রাত ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাতেন এবং অবশিষ্ট এক-ষষ্ঠাংশ রাত ঘুমাতেন। তিনি

একদিন রোযা রাখতেন এবং একদিন পানাহার করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১১৩১)
হযরত দাঊদ আ. এর এমন সাধনা এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর নামায-রোযার প্রতি এমন স্তুতি-প্রশংসা কুড়ানোর পরও তিনি একটা ন্যূনতা অনুভব করতেন। নির্জন-নিভৃতে রোনাজারি করতেন। দু’হাত তুলে মাবুদের শুকরিয়া জ্ঞাপনে নিজের গাফলতির কথা স্বীকার করতেন। কাতর মিনতি করে বলতেন, মাবুদ! আমার প্রতিটি পশমের পরিবর্তে যদি দু’টি করে জবান থাকতো এবং যুগ যুগ ধরে দিবারাত্রিতে তোমার তাসবীহ পাঠে মশগুল থাকতো তবুও তোমার নেয়ামতরাজি থেকে একটি নেয়ামতের হক আদায় করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।

হযরত দাঊদ আ. এর হৃদয়ে জাহান্নামের আগুনের ভয় ও দুশ্চিন্তা ভরপুর ছিল। প্রতিদান দিবসের শঙ্কা সবসময় মনে জাগরিত ছিল। নানা শঙ্কায় শঙ্কিত থাকতেন। জীবনভর খোদাভীতির মূর্তপ্রতীক ছিলেন। মাবুদের সকাশে সবসময় ভয়তরাসে থাকতেন। মুহূর্তের জন্য তাঁর অশ্রু থেমে থাকতো না। নীরবে চোখের জলে নয়ন ভাসতো। এতে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়ার উপক্রম হল। এ ব্যাপারে তিনি তিরস্কৃত হলেন। কেন এতো কান্না ?! তিনি বলতেন, কাঁদার দিন আসার আগে আমাকে কাঁদতে দাও। যে দিন হাড়গোড় জ্বলে ভস্মিভূত হয়ে যাবে। তিনি অতিশয় রোনাজারি করে দোআ করতেন। হাঁটু গেড়ে বসে আল্লাহ তাআলা-এর কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতেন। মাবুদ, তোমার সূর্যের আলো-ই সহ্য হয় না। তোমার জাহান্নামের আগুন কিভাবে বরদাস্ত হবে ?! তোমার রহমতঘেরা বজ্রনির্ঘোষ কানে সয় না। তোমার আযাবের শব্দ কিভাবে সইব ?!

কখনও তাঁর হৃদয়ের চারপাশে ঘেঁষতে পারেনি অহঙ্কারের কণা বা অণু। নবুওতে তাঁর পরহেযগারি বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজত্বে তাঁর বিনয়ের ভূষণ আরও রওশন হয়েছে। হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম শুধু নিজের হাতের উপার্জন থেকে আহার গ্রহণ করতেন। চোখের সামনে পবর্তসম রাজত্বের আহার সামগ্রী থেকে একটি লুকমাও গ্রহণ করেননি। উদরে প্রবেশ করেনি একটি গ্রাসও। তিনি লৌহবর্ম আর খেজুর পাতার টুকরি বানিয়ে বিক্রি করতেন। রোজগার দিয়ে আহার সামগ্রী ক্রয় করে খেতেন। মহানবী ﷺ হযরত দাঊদ আলাইহিস সালামের প্রশংসা করে বলেছেন:
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلَام كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ
নিজের হাতের আয়-উপার্জনের আহার চেয়ে কারও উত্তম আহার আর নেই। আল্লাহ-এর নবী হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম নিজের কামাই-রোজগার থেকে খেতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ২০৭২)। লোকজনকে নিজের চুলা থেকে সত্তর স্তূপ চাপাতি রুটি খাইয়েছেন। কিন্তু নিজে খেয়েছেন যবের রুটি।

তিনি খুব আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলেন। বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে দরজায় তালা লাগিয়ে যেতেন। তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত তাঁর অন্দরমহলে কারও প্রবেশের কোন ব্যবস্থা ছিল না। একবার তিনি এভাবে দরজা বন্ধ করে চলে যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী উঁকি দিয়ে দেখেন অন্দরমহলের আঙ্গিনায় একপুরুষ লোক দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে কে? এই লোক বাড়ির ভেতরে কিভাবে প্রবেশ করলো অথচ গেইট বন্ধ? ইতোমধ্যে দাঊদ আলাইহিস সালাম ফিরে এসে দেখেন বাড়ির ভেতর এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। দাঊদ আলাইহিস সালাম দিয়ে বললেন, তুমি কে? আমি কোন বাদশাহকে ভয় করি না এবং কোন প্রতিবন্ধকতা আমাকে আটকাতে পারে না। দাঊদ আলাইহিস সালাম বললেন, তাহলে তুমি মালাকুল মওত। মৃত্যু পরওয়ানা নিয়ে হাজির মৃত্যু ফেরেশতা তোমাকে স্বাগতম। আল্লাহর হুকুমের সামনে আমি একদম প্রস্তুত। তাঁর হুকুম শিরোধার্য। মুহূর্তের মধ্যে তিনি পরলোকগমন করলেন। গোসল ও কাফনের পর সূর্যের আলো দেখা দেয়। সুলাইমান আলাইহিস সালাম পক্ষীকুল লক্ষ্য করে বললেন, দাঊদ আলাইহিস সালামকে ছায়া দান করো। পাখপাখালি ছায়াঘেরা করলে পৃথিবী তাঁকে পরিবেষ্টিত করে। এরপর পাখিকুল তাদের ডানা গুটিয়ে নেয়।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it