মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১১০ হিজরী : ৭২৮ খৃস্টাব্দ)

ফেরেশতাদের মাঝে হযরত জিব্রাঈল আ. যেমন ছিলেন যাহিদ ও দুনিয়াবিরাগীদের মাঝে তিনি এমন ছিলেন। অন্তর থেকে আত্মপ্রতারণা ও মোহ পরিত্যাগ করেছিলেন। কল্যাণ ও তাকওয়ার কোলে যিনি প্রতিপালিত। এমন ব্যক্তি যাঁর মুখ দিয়ে তাসবীহ-তাহলীল নিঃসৃত হতো। ইবাদত ও মাবুদের ধ্যানে যিনি নীরব থাকতেন। যিনি দুনিয়াকে আলোকিত করেছিলেন আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের মোহে পড়ে। তিনি মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন আলবসরী। মনীবের বংশসূত্রে যিনি আনসারী। আবূ বকর উপনাম। বসরা নগরীর ইমাম ও প্রধান মুসলিম মনীষী। যুগশ্রেষ্ঠ মুত্তাকী ও খোদাভীরু ব্যক্তি।

আমীরুল মুমিনীন হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. এর শাসনামলের মাত্র দুই বছর বাকি, তখন এই মনীষী জন্মগ্রহণ করেন। এমন ঘরে লালিত-পালিত হন যার চারদিক তাকওয়ার ঘ্রাণে সুবাসিত। প্রথম জীবনে কাপড় বিক্রি করতেন। তখন তিনি জাগতিক কাজে ব্যস্ত হলেও মনেপ্রাণে ইলমে ওহীই তিনি লালন করছিলেন। তাই তো তিনি একাধারে ফকীহ-ইসলামী আইনজ্ঞ, হাদীস বর্ণনাকারী, ফারায়েয, বিচার ও গণিত বিশেষজ্ঞ হিসেসে সমধিক পরিচিত।

তাকওয়ার সুনাম দিগন্তব্যাপী। স্বপ্নের তাবীর ও ব্যাখ্যার ব্যাপারে যাঁকে প্রায় অদ্বিতীয় বলা যায়। একবার হযরত আনাস বিন মালেক রা. তাঁর কাছে চিঠি লিখেন। তখন তিনি পারস্য দেশে। তাঁর বাবা হযরত আনাস রা. এর আযাদকৃত গোলাম ছিল। প্রকৃতিগতভাবে শান্ত, নীরব এবং বিনয়ী ছিলেন। লোকজন তাঁকে দেখলে আল্লাহ তাআলার কথা মনে পড়তো। মসজিদে প্রবেশ করেই কাপড় দিয়ে মসজিদ ঝেড়ে নিতেন।

নিজের জীবনকে দু’ভাগ করেছিলেন। একভাগ ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য আরেকভাগ আয়-উপার্জন করার জন্য। বেলা বাড়ার পর মসজিদ থেকে বাজারে চলে যেতেন। রাতের বেলায় ইবাদতের ছোট কুঠরিতে নিমগ্ন হয়ে পড়তেন। তিনি একদিন রোযা রাখতেন। অন্যদিন রোযা না রেখে কাটাতেন। মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করতেন। মায়ের সাথে কটু মুখে কখনও কথা বলতেন না। সাধারণ কথা সুবহানাল্লাহ আর আলহামদুলিল্লাহ! সত্য কথা ব্যক্ত করতেন নির্দ্বিধায়। যখনই দু’টি বিষয় সামনে আসতো তিনি দ্বীনের জন্য সুদৃঢ় পথ ও বিষয়টিই গ্রহণ করতেন। লোকজন তাঁর প্রশংসা করে ফিরতো। লোকমুখে তাঁর তারিফ লেগেই থাকতো। আল্লামা আ’জালী বলেন, ইবনে সীরীনের ফিকহ ও তাকওয়ার চেয়ে অন্য কারও মাঝে সেগুলো তেমন দেখা যেতো না। তিনিই ছিলেন সর্বোত্তম ফকীহ-আইন বিশেষজ্ঞ এবং মুত্তাকী।

হযরত বকর ইবনে আব্দুল্লাহ্ আলমুযানী রহ. বলেন, ‘কেউ যদি যুগশ্রেষ্ঠ মুত্তাকী লোক দেখতে চায় সে যেন ইবনে সীরীনকে দেখে।’ তাকওয়া, আত্মশিক্ষা ও পরিশীলনের ব্যাপারে তাঁর কথা প্রবাদতুল্য। তিনি বলতেন, আল্লাহ তাআলা যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান তিনি তার অন্তরকে তার জন্য উপদেশকারী বানিয়ে দেন। তার অন্তরই তাকে উপদেশ দেয়, ভাল কাজ করতে বলে এবং খারাপ কাজ থেকে বারণ করে। হযরত ইবনে সীরীন রহ. ইবাদতগুজার, মুত্তাকী ও দুনিয়াবিমুখ ব্যক্তি ছিলেন। দ্বিপ্রহরে বাজারে প্রবেশ করার সময় বলতেন, আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ্ এবং তিনি যিকির করতেন। জনৈক লোক বলল, আবূ বকর (ইবনে সীরীন), এই সময়? (এখন কি যিকিরের সময়?)। তিনি বললেন, এখন ঘুমানো ও বিশ্রামের সময়। এ মুহূর্তে আল্লাহ তাআলার যিকির করতে আমার ভাল লাগছে।

হযরত ইবনে সীরীন রহ. জনৈক ব্যক্তিকে স্মরণ করলেন। যাতে মানুষের মাঝে তার পরিচিতি হয়ে যায়। সেই কৃষ্ণাঙ্গ লোকটি। লোকটিকে এভাবে উপস্থাপন করায় তিনি লজ্জিত হলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তার ভুল হয়ে গেছে। এরপর বললেন, আস্তাগফিরুল্লাহ্! আল্লাহ’র কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, এতে আমি তার গীবত ও পরনিন্দা করে ফেলেছি।

একদিন একলোক উচ্চস্বরে শোক সংবাদ প্রচার করছে। দিগন্তজুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে হযরত আনাস বিন মালিক রা. এর ইন্তেকালের খবর। হযরত আনাস রা. ওসিয়ত করেছিলেন যে, তাঁকে যেন ইবনে সীরীন গোসল দেয়। তখন ইবনে সীরীনকে হযরত আনাস রা. এর মৃত্যুর খবর জানানো হল। তখন তিনি বন্দী ছিলেন। ইবনে সীরীন রহ. বললেন, আমি তো বন্দী। লোকজন বলল, আমরা বাদশাহ’র নিকট অনুমতি চাইলে তিনি এ ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন। ইবনে সীরীন রহ. বললেন, বাদশাহ আমাকে আটক করেনি। আমার কাছে যার পাওনা ছিল সেই আমাকে আটক করেছিল। তার অনুমতিতে আমি বের হয়েছি। এরপর তিনি বের হয়ে গোসল দিলেন।

তাঁর মজলিস ছিল কল্যাণ, উপদেশ ও ওয়াজ-নসিহতমূলক। তাঁর আসরের চারদিক থেকে তাকওয়ার সুগন্ধি ছড়াতো। একবার ইবনে সীরীন রহ. শোনতে পেলেন জনৈক ব্যক্তি বাদশাহ হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফকে গালি দিচ্ছে। তিনি লোকটির দিকে এগিয়ে গিয়ে উপদেশছলে বললেন, মিয়া, থামো। মনে রেখো, আল্লাহ তাআলা ন্যায়পরায়ণ ও ইনাসাফগার শাসক। তিনি জালিম থেকে মজলুমের হক আদায় করে দিবেন। হাজ্জাজ যদি কারো প্রতি জুলুম করে এবং অন্যের হক নষ্ট করে তিনি তার হক ফিরিয়ে দিবেন। তেমনিভাবে কেউ যদি হাজ্জাজের প্রতি জুলুম করে তিনি (হাজ্জাজ জালিম হওয়া সত্ত্বেও) তা তাকে ফিরিয়ে দিবেন। সুতরাং তুমি কাউকে গালি দিও না। মজলুম তার হক ফিরিয়ে পাবেই পাবে।

হযরত ইবনে সীরীন রহ. কোন কিছু বিক্রি করার সময় ক্রেতাকে বলতেন, পছন্দ হয়েছে? তোমার মন মতো হয়েছে তো? এভাবে তিনবার বলতেন। ক্রেতা হাঁ বললে ইবনে সীরীন রহ. সাক্ষী নিয়ে আসতেন। হযরত সারী ইবনে ইয়াহইয়া রহ. ইবনে সীরীন রহ. এর তাকওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন, সন্দেহের কারণে ইবনে সীরীন রহ. চল্লিশ হাজার দিরহাম লাভের অর্থ ছেড়ে দিয়েছেন। আরেকবার আশি হাজার মুদ্রার পণ্য কিনে মনে খটকা লাগার কারণে বাদ দিয়েছিলেন। একবার তাঁকে একটি ফিকহী বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সেটি হালাল না হারাম? এতে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মাঝে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে গেলো।

একবার তিনি চল্লিশ হাজার মুদ্রার তৈল বাকিতে খরিদ করলেন। একটি কৌটা খোলে দেখেন তাতে একটি মরা ইঁদুর বিভৎস অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি বললেন, এসব তেল একই ঘানি থেকে তৈরিকৃত। এই নাপাকি শুধু একটি কৌটায় আছে এমন নয়। বরং সকল কৌটায় এই নাপাকি ছড়িয়ে রয়েছে। এগুলো যদি আমি বিক্রেতাকে ফিরিয়ে দেই সে হয়তো মানুষের কাছে সেগুলো বিক্রি করে দিবে। এ কথা বলে সব তৈল মাটিতে ফেলে দিলেন।

দ্বীনের রহস্য ও গূঢ়তত্ত্ব বোঝার বিশেষ ধীশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। মহান আল্লাহ তাআলা সমঝ দিয়ে তাঁর অন্তর আলোকিত করেছিলেন। একবার জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে দুই দিরহাম আমানত কথা দাবি করল। কিন্তু ইবনে সীরীন রহ. তা অস্বীকার করলেন। লোকটি বলল, আপনি কসম খেতে পারবেন। (লোকটি মনে করছিল, দুই টাকার জন্য তিনি কসম খাবেন না)। তিনি বললেন, হাঁ। এ কথা বলে কসম খেলেন। লোকজন বলল, হে আবূ বকর (ইবনে সীরীন), মাত্র দুই দিনারের জন্য কসম খেয়ে ফেললেন? তিনি পূর্ণ ঈমান ও আস্থা নিয়ে বললেন, হাঁ আমি কসম খাচ্ছি। আমার জানামতে তার দাবিকৃত টাকা সম্পূর্ণ হারাম। আমি জেনেশোনে তাকে হারাম খাওয়াতে চাইলাম না।

সত্য বিষয় ও সত্য কথা নির্দ্বিধায় বলে বেড়াতেন। আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করতেন না। মানুষ কী বলবে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। হিশাম রহ. বলেন, বাদশাহ’র সামনে ইবনে সীরীন রহ. এর মতো এমন কঠোর অন্য কাউকে আমি দেখিনি। একবার ইরাকের উমাইয়্যা শাসক উমর ইবনে হুবাইরা হযরত ইবনে সীরীন রহ.কে ডেকে পাঠালেন। তিনি নিজের ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে তার কাছে গেলেন। দরবারে প্রবেশের পর গভর্নর তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, আবূ বকর (ইবনে সীরীন), আপনি এলাকার লোকজনকে কোন অবস্থায় রেখে এসেছেন? তিনি বললেন, তাদের মাঝে জুলুমের বিস্তার খুব বেশি। তারা গণহারে জুলুমের শিকার। তাদের নিয়ে আপনার কোন গ্রাহ্যতা নেই। উদাসীনতা আপনার মাঝে ছেয়ে গেছে। ভাতিজা কাঁধের ইশারায় থামতে বললেন। তিনি উত্তরে বললেন, তুমি তো জিজ্ঞাসিত হচ্ছো না। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। এটা তো সাক্ষ্য প্রদানের নামান্তর। আর যে ব্যক্তি সাক্ষ্যদান গোপন করে অবশ্যই তার অন্তর পাপী। (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৮৩)
এক পর্যায়ে গভর্নরের মজলিস ভেঙে যায়। ইবনে হুবাইরা একই সমাদরে হযরত ইবনে সীরীনকে বিদায় জানালেন। তিন হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) ভরে একটি ব্যাগ দিলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।

হিজরী ১১০ সালে এই মহামনীষী দুনিয়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমান। বসরা নগরীর মাটিতে তিনি সমাহিত হন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it