দাঊদ আত্তায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি (মৃ. ১৬৫ হিজরী : ৭৮১ খৃস্টাব্দ)

এই দাঊদ যদি আগেকার যুগে থাকতো অবশ্য আল্লাহ তাআলা তাঁর গল্পেরও বিবরণ দিতেন। ধনৈশ্বর্য ছাড়া আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। বংশীয় কৌলীন্য ব্যতীত যাকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা যাকে মনুষ্য সমাজ ব্যতিরেকে সঙ্গ দিয়েছেন। যিকিরে জবান সিক্ত রাখতেন। শৃঙ্খলিত হওয়ার আগে নিজেকে আনুগত্যের নিগড়ে নিগড়িত করেন।
দানশীলতা লাগাম ডান হাতে রেখেছেন। অনায়াসেই যিনি দানের পৃষ্ঠদেশে আরোহণ করেছিলেন। তিনি আবূ সুলাইমান দাঊদ আত্তায়ী। কুফা নগরের অধিবাসী। বিখ্যাত ইমাম ও শাস্ত্রীয় প-িতপ্রবর ব্যক্তি। ফকীহ ও ইসলামী আইনজ্ঞ। দুনিয়াবিমুখ ও যাহিদ। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। বুযর্গ ও নেককার মানুষ। ফিকহশাস্ত্রের অন্যতম ইমাম। শাস্ত্রীয় ব্যক্তিত্ব। বিশিষ্ট গবেষক ও যুক্তিনির্ভর মাসআলা প্রণেতা। ইমাম আবূ হানীফা রহ. থেকে ফিকহশাস্ত্র লাভ করেছেন।
পরবর্তীতে তিনি ব্যক্তিগত বিষয়ে মনোনিবেশী হয়ে পড়েন। নীরবতা অবলম্বন করেন। লোকজন সিংহ দেখলে যেভাবে পালিয়ে বেড়ায় তিনিও ঠিক সেভাবে দুনিয়াকে পরিহার করে চলেছেন। তাকে কোন হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করা হলে বলতেন, আগে আমাকে আমার বিষয়ে গোছানোর সুযোগ দাও। তাকে কোন আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বলতেন, উত্তর দেয়া শেষ হয়ে গেছে।
তার যুহদের প্রধান কারণ হল, একবার তিনি গোরস্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে এক মহিলা বিলাপ করছে। সে বলছে, তোমার কোন্ গ-দেশে জীর্ণতা ধরেছে এবং কোন্ চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু জমাট বেঁধেছে? (এই কথা শোনে তার মাঝে দুনিয়া বিরাগের বিষয় প্রবল হয়ে ওঠে)।
দাঊদ তায়ী বলেন, যাহিদ সেই ব্যক্তি যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিত্যাগ করেছে। তিনি বলতেন, যে বান্দাকে আল্লাহ তাআলা গুনাহের লাঞ্ছনা থেকে বের করে তাকওয়ার ইজ্জতের দিকে টেনে নিয়ে এসেছেন তাকে তিনি বিত্ত-বৈভব ছাড়াই মালদার বানিয়ে দিবেন, লোকবল ব্যতিরেকে সম্মানিত করবেন এবং মনুষ্য সঙ্গ ব্যতীত তাকে পরিচিত সমাজে বাস করাবেন।
তিনি বলতেন, যুহদ ও দুনিয়াত্যাগের জন্য ইয়াকীন ও ধ্রুববিশ্বাসই যথেষ্ট। ইবাদতের জন্য ইলমই যথেষ্ট। আর ব্যস্ততার জন্য ইবাদতই যথেষ্ট। একবার তার কাছে হারেস ইবনে ইদরীস আসে। সামনে গিয়ে বসে। বলল, আমাকে একটু ওসিয়ত করুন। দাউদ বললেন, মৃত্যুর সৈন্যরা তোমার অপেক্ষা করছে। আরেকজনকে বললেন, দুনিয়ার রোযা রাখো। মৃত্যু দিয়ে ইফতার কর। হিংস্রপ্রাণী থেকে যেভাবে লোকজন পালিয়ে বেড়ায় তুমিও সেভাবে লোকজন থেকে পালিয়ে বেড়াও। মুত্তাকী লোকদের সাথে লেগে থাকো।
একবার একলোক দাঊদ তায়ীকে এক হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। দাউদ তায়ী বলল, আগে আমার জীবনকে উদ্ধার করতে দাও। সুফইয়ান সাওরী রহ. বলতেন, তায়ী! আগে নিজের বিষয় গোছাও। সবার আগে নিজের মুক্তির চিন্তা কর।
সুফইয়ান সাওরী তার নিকট বসে আছেন। দাউদ তায়ী বললেন, আপনি যদি ঠা-া পানি পান করেন, সুস্বাদু খাবার গ্রহণ করেন এবং ছায়াদার স্থান দিয়ে হেঁটে যান তবে আপনি কবে মৃত্যুকে পছন্দ করবেন এবং আল্লাহ তাআলার প্রতি মনোনিবেশী হবেন? সুফইয়ান সাওরী খুব কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেল।
ইবনে সিমাক আসল। দাউদ তায়ীকে বলল, আমাকে ওসিয়ত করুন। দাউদ তায়ী বললেন, দেখ, আল্লাহ তাআলা যেন তোমাকে এমন কাজে বা স্থানে না দেখেন যা তিনি তোমার নিষিদ্ধ করেছেন। যেখানে তিনি থাকতে বলেছেন সেখানে যেন তিনি তোমাকে অনুপস্থিত না পান। তোমার ব্যাপারে তার নৈকট্য এবং তার কুদরতের কথা স্মরণ করে লাজুকতা বোধ কর।
দাউদ তায়ী দু’হাতে দুনিয়া সরিয়েছেন। বুকেও সহযোগিতা নিয়েছেন। নিজেকে অবিরাম কসরত করে নিকষিত করেছেন। দুনিয়া তার হাতে অস্থায়ীভাবে ছিল। দুনিয়া তার উদরকে বেশি ব্যস্ত রাখতে পারেনি। এক ক্রীতদাসী বলল, অনুমতি হলে আপনার জন্য সামান্য চর্বি তৈরি করে দিবো….তিনি বললেন, কর। মহিলা চর্বি রান্না করে নিয়ে হাজির। তিনি তাকে বললেন, অমুক গোত্রের অনাথ ও এতিম ছেলেদের কী অবস্থা? বাঁদি বলল, তারা তাদের অবস্থায় আছে (অর্থাৎ তাদের আহারের কোন ব্যবস্থা হয়নি। তিনি বললেন, এই খাবার তাদের জন্য নিয়ে যাও। আমি খেলে টয়লেটে যাবে। ঐসব এতিম ছেলেরা খেলে আল্লাহ তাআলার নিকট সঞ্চয় হবে।
আসর নামাযের পর দাউদ পরিবারের এক মহিলা ঘি দিয়ে ‘সারীদ’ তৈরি করে ইফতারের সময় দাউদের নিকট কাজের লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কাজের বুয়া খাবারটি দাউদের সামনে নিয়ে রাখে। তিনি সেখান থেকে খাওয়ার মনস্থ করেন। এমন সময় এক ভিখারি দরজায় এসে হাঁক পাড়ে। তিনি উঠলেন। সবটুকু খাদ্য পাত্রসহ ভিখারিকে দিলেন। উভয়জন দরজায় বসে খেয়ে নিলেন। এরপর পাত্রখানা ধুয়ে নিলেন। রাতের খাবারের জন্য কিছু খেজুর ছিল। তিনি সেগুলো পাত্রে দিয়ে কাজের বুয়াকে দিলেন। বললেন, (যে খাবার তৈরী করেছে) তাকে সালাম দিবে। কাজের বুয়া বলল, আমি যা নিয়ে আসলাম তা আপনি ভিক্ষুককে দিয়ে দিলেন। আর রাতে খাওয়ার জন্য যা রেখেছিলেন তা আমাদেরকে দিয়ে দিলেন। আমার মনে হয় আপনি এই রাতে অনাহারে কাটাবেন।
এক ব্যক্তি দাউদ তায়ীর নিকট গেল। মাগরিবের পর তার বাড়িতে গিয়ে হাজির। দাউদ তায়ী তার জন্য কিছু শুষ্ক রুটির টুকরা এগিয়ে দিলেন। লোকটির পানির পিপাসা লাগল। পানির পাত্র থেকে পানি নেওয়ার উদ্দেশ্যে সে দাঁড়াল। দেখলো পানি গরম। লোকটি বলল, দাউদ! আল্লাহ তোমাকে রহম করুন, এই পাত্রে পানি না রেখে অন্য পাত্রে রাখতে পারলে ভালো হতো না! (ঠা-া পানি পান করার সুযোগ হতো)
তিনি বললেন, আমি যদি শুধু ঠা-া পানিই পান করি, সুস্বাদু খাবারই গ্রহণ করি এবং কেবল মোলায়েম কাপড় পরিধান করি তাহলে তো আখেরাতের জন্য কোন কিছু সঞ্চয় করলাম না। তিনি জানতেন যে, দুনিয়া ধোঁকার জগত। তাই তিনি দুনিয়া গড়ার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেননি। দুনিয়া সঞ্চয়ে নিজেকে ঘর্মাক্ত করেননি। একদিন এক আগন্তুক দাউদের নিকট তার বাড়িতে উপস্থিত। নজর করে দেখে, আরাম-আয়েশের কোন কিছু নেই। বাড়িটি বিরান জায়গাসদৃশ। ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে সর্বত্র। লোকটি করুণাপরবশ হয়ে বলল, আপনি তো বাস করেন একটি নিঃসঙ্গ বিজন বাড়িতে।
খোদাভীতিতে টইটুম্বর হৃদয় নিয়ে তিনি বললেন, কবরের নিঃসঙ্গতা আমার কাছে মুখ্য। দুনিয়ার নিঃসঙ্গতা সেই নিঃসঙ্গতার সামনে মøান হয়ে গেছে। সালিহ আজালী দাউদ তায়ীর বাড়ির বর্ণনা দিচ্ছেন। আমি দাউদের বাড়িতে গেলাম। তখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। গিয়ে দেখি, তার বাড়িতে শুষ্ক রুটির পাত্র, উযুর পাত্র আর কাঁচা মাটির তৈরী বালিশ। এগুলো ছাড়া অন্য কোন কিছুই নেই।
পূবাহ্নের সময় হাম্মাদ ইবনে আবূ হানীফা গেলেন দাউদে তায়ীর নিকট। তিনি তাকে বলতে শোনছেন যে, (নিজেকে লক্ষ্য করে বলছেন) আখরোট খেতে চাইলে আমি তোমাকে আখরোট খাওয়ালাম। আবার তুমি আখরোট আর খেজুর খেতে চাইলে। আমি কসম খেয়ে বললাম, এগুলো কখনও তুমি খেওনা। হাম্মাদ বলল, আমি তার নিকট প্রবেশ করলাম। গিয়ে দেখি তিনি নিজেকে তিরস্কৃত করছেন।
একদিন দাউদ তায়ী বের হলেন। তার গায়ে ছেড়া জুব্বা। দারিদ্র্যপীড়িত জামা তার পরিধেয়। এক লোক দেখে বলল, এগুলো সেলাই করে নিলেও তো হয়? দাউদ বললেন, তুমি কি জানো না যে, তিনি অনর্থক দৃষ্টি দিতে নিষেধ করেছেন।
দাউদ তায়ী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। লোকজন তাকে দেখতে আসলো। তারা তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। তারা প্রস্তাব করলো, আবূ সুলাইমান! বাড়ির আঙিনায় বের হলে ভালো হবে। এখানে বেশ বাতাস। আপনার জন্য আরামদায়ক হবে। দাউদে তায়ী বললেন, শারীরিক প্রশান্তির জন্য আমি দু’এক কদম হেঁটে গিয়ে গুনাহ কামাতে চাই না। মহান এই মনীষী হিজরী ১৬৫ সালে মারা যান।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it