উমাইর ইবনে সা’দ রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ২০ হিজরী : ৬৪১ খৃস্টাব্দ)

হৃদয়ের তন্ত্রীতে যুহদের বাণী উচ্চারিত হয়েছে। ইতিহাসের গতিতে চলেছেন সম্মুখ পানে। ইতিহাস তাঁকে স্থান দিয়েছে বড়দের সারিতে। যুহদ ফেরেশতা তাঁর হৃদয়ের সাথে করমর্দন করেছে। জাগতিক ভীতি দিয়ে পরকালের নিরাপত্তা খরিদ করেছেন। উমাইর ইবনে সা’দ। ইতিহাসের পাতায় পাতায় যাঁর গল্প ধ্বনিত হচ্ছে। তিনি আমীর ও যাহেদ। সিরিয়া বিজয়ের সহযোগী। হযরত উমর রা. তাঁকে হিমস শহরের নগরপাল নিযুক্ত করেছিলেন। সেখানে এক বছর অবস্থান করার পর তাঁকে উমর রা. মদীনায় তলব করেন। পরবর্তীতে আবার পাঠাতে চাইলে তিনি তা অস্বীকৃতি জানান।

পৃথিবীকে ঈমান ও দৃঢ়বিশ্বাস দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন। দুনিয়া পরিত্যাগ করার মানসে তাঁর কথাগুলো বের হয়েছে অন্তরের অন্তস্তল থেকে। তাই জাগতিক হৈচৈ তাঁর তাকওয়া-তাহারাতের চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারেনি। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমর রা. বলেন, গোটা সিরিয়ায় উমাইরের চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না। উমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাঁকে হিমসের নগরপাল করে পাঠিয়েছেন। এক বছর সেখানে অবস্থান করেছেন। এ সময়ের মধ্যে তাঁর কোন সংবাদ মদীনায় না আসায় উমর রা. তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন, উমাইর-এর নিকট পত্র লিখো। কসম, মনে হয় সে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। পত্রে বলা হল, পত্র পাওয়ামাত্র মদীনায় চলে আসবেন। সাথে রাজস্ব নিয়ে আসবেন।

পত্র পেয়ে হযরত উমাইর রা. থলেতে কিছু পাথেয়, পানীয় ও ছড়ি নিয়ে পায়ে হেঁটে হিমস থেকে মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। মদীনায় এসে পৌঁছার পর তাঁর শরীরের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চেহারা ধুলায় ধূসরিত। মাথার চুলগুলো বেশ বড় হয়েছে। এসে প্রবেশ করলেন উমর রা.-এর নিকট। বললেন, আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ, ইয়া আমিরাল মুমিনীন। তাঁর ব্যাপারে উমর রা. এর মনে ভালো ধারণা ছিল না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? তিনি নিজের ব্যাপারে পুরোপুরি আস্থাশীল হয়ে উত্তর দিলেন, আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন আমার অবস্থা। আগে আমার শরীর-স্বাস্থ্য ভালো ছিল।

উমর রা. জিজ্ঞেস করলেন, সাথে কি নিয়ে এসেছেন? দুনিয়া পরিত্যাগকারীর মর্যাদাপূর্ণ অনুভূতি নিয়েই বললেন, আমার সাথে সামান্য পাথেয় রাখার থলে। খাবারের পাত্র। যা শরীর ও কাপড় ধোয়ার কাজেও ব্যবহার করি। আর আছে পানপাত্র। যা দিয়ে উযুও করি এবং পানের কাজও চলে। আর আছে এই ছড়ি। যা ভর দিয়ে চলি এবং দুশমন সামনে লড়াইয়ের কাজ করি। দুনিয়া বলতে এগুলোই আমার সম্বল।

উমর রা. বললেন, পায়ে হেঁটে এসেছেন? বললেন, হাঁ। উমর রা. বললেন, আপনার কি এমন কেউ নেই যে আপনাকে একটা বাহন দিবে? বললেন, তারা দেয়নি আর আমিও চাইনি। উমর রা. বললেন, সেখানকার মুসলমান খুব খারাপ। যাদের থেকে আপনি বেরিয়ে এসেছেন। বললেন, উমর! আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহ ত’আলা তো গীবত করতে নিষেধ করেছেন। আমি তাদেরকে দেখে এসেছি তারা সকালের নামায আদায় করছে। উমর রা. বললেন, আপনাকে সেখানে পাঠানোর পর কী অবদান রেখেছেন? তিনি বললেন, কসম! আমি না বললে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন তাই আমাকে বলতে হচ্ছে। আমি নগরের নেক ও মহৎ লোকদেরকে জমায়েত করে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব তাদেরকে দিয়েছি। তারা সেগুলো সংগ্রহ করে আমার নিকট দিয়েছে। আমি সেগুলো প্রাপক ও নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করেছি। উদ্বৃত্ত কিছু থাকলে আপনার দরবারে এনে হাজির করতাম।

উমর রা. বিস্মিত হয়ে বললেন, তাহলে কি সামান্য কিছুও আনেননি? বললেন, না। উমর রা. বললেন, উমাইরকে পুনরায় সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। বললেন, আপনার এবং পরবর্তী কারও পক্ষে পদস্থ কর্মকর্তা হয়ে কাজ করবো না। কসম, আমি তো কলঙ্কিত হয়ে গেলাম। অথচ সেখানের দিনগুলো আমার সবচেয়ে কষ্টকর ছিল। এরপর তিনি বিদায়ের জন্য অনুমতি চাইলে হযরত উমর রা. তাঁকে অনুমতি দিলেন।

এরপর হযরত উমর রা. হারেস নামের আরেক লোককে একশত দিনার দিয়ে নগরপাল করে পাঠালেন। বললেন, তুমি উমাইর ইবনে সা’দ রা.-এর নিকট যাও। মেহমান হয়ে তাঁর কাছে থাকো। ভালো ও সচ্ছল অবস্থা দেখলে ঠিক আছে। দুরবস্থা দেখলে তাঁকে এই দিনারগুলো দিয়ে আসবে।
হারেস হযরত উমাইর ইবনে সা’দ রা.-এর পেছনে দ্রুত গেলেন। গিয়ে দেখেন তিনি দেয়ালের পাশে বশে কাপড় পরিষ্কার করছেন। সালাম দিলেন। উমাইর রা. বললেন, আসুন। আল্লাহ ত’আলা আপনার উপর রহম করুন। নেমে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় হতে এসেছেন? লোকটি বলল, মদীনা হতে। উমাইর রা. বললেন, আমীরুল মুমিনীনকে কেমন দেখে আসলেন? বলল, ভালো। উমাইর রা. প্রশ্ন করলেন, তিনি কি দণ্ডবিধি প্রয়োগ করেন না? বলল, হাঁ। অশ্লীল কাজের জন্য নিজের ছেলেকে প্রহার করেছিলেন। অবশেষে সে মারা যায়। উমাইর রা. বললেন, হে আল্লাহ! উমরকে সম্মানিত করুন। আমার জানা মতে তিনি আপনাকে খুব ভালোবাসেন।

হারেস মেহমান হয়ে তিন দিন হযরত উমাইর ইবনে সা’দ রা. নিকট ছিলেন। সামান্য যব দিয়ে তাঁর পরিবারের লোকজন আপ্যায়ন করে। নিজেরা ছিল ক্ষুধার্ত। তিন দিন পর উমাইর রা. বললেন, কাজ সেরে থাকলে অনুগ্রহ করুন। এই কথা শোনে মেহমান দিনারগুলো উমাইর রা.কে দিলেন। আমীরুল মুমিনীন আপনাকে নিজের প্রয়োজন মতো খরচ করার জন্য দিয়েছেন। উমাইর রা. এ কথায় কাঁপতে লাগলেন। বলতে লাগলেন, এগুলো আমার দরকার নেই। ফিরিয়ে নিন। তখন তাঁর সহধর্মিণী বললেন, আপনার দরকার না থাকলে গরিব-দুঃখীদেরকে দান করে দিন। উমাইর রা. বললেন, তা আমার প্রয়োজনে পড়ে না। এ কথা শোনে সহধর্মিণী লৌহবর্মের নিচের অংশ ছিঁড়ে ফেললেন। সেখানে রাখা হল সেসব দিনার। যেগুলো শহীদ ও দীনদরিদ্র লোকদের সন্তান-সন্ততিদের মাঝে বিতরণ করে দিলেন।

উমাইর রা. মেহমানকে বললেন, আমীরুল মুমিনীনকে আমার সালাম দিবেন। এরপর হারেস ফিরে আসলেন উমর ইবনুল খাত্তাবের নিকট। উমর রা. বললেন, কী খবর? হারেস বলল, অবস্থা বেহাল। উমর রা. বললেন, দিনারগুলো কী করেছে? বললেন, জানি না। উমর রা. পত্র লিখলেন উমাইর ইবনে সা’দ রা. এর নিকট। আমার এই চিঠি পাওয়ার পর পত্র হাত থেকে না রেখেই আমার সাথে দেখা করো। চিঠি পেয়ে উমাইর রা. আসলেন। উমর রা. বললেন, দিনারগুলো কী করেছো? বললেন, যা করার করেছি। এতে আবার জিজ্ঞাসা করার কী আছে? উমর রা.বললেন, দোহাই লাগে বলো কী করেছো সেসব দিনার? বললেন, আগামী দিনের জন্য পাঠিয়েছি। (অর্থাৎ পরকালের জন্য সঞ্চয় করেছি)। উমর রা. অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন, আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন। এরপর হযরত উমর রা. তাঁর জন্য একটি উট বোঝাই খাদ্যসামগ্রী ও দুটি কাপড় দেওয়ার হুকুম করলেন।

উমাইর রা. দুনিয়া বিরাগী কণ্ঠে বললেন, খাবার তো আমার দরকার নেই। বাড়িতে এইমাত্র দুই সা’ যব রেখে এসেছি। হতে পারে সেগুলো শেষ হওয়ার আগেই আরও খাবারের ব্যবস্থা আল্লাহ ত’আলা করে দিবেন। তবে কাপড়গুলো আমার সহধর্মিণীর দরকার। এ কথা বলে দু’টো কাপড় নিয়ে বাড়িতে চলে আসলেন। এই ঘটনার পর এই সাধক ও দুনিয়া বিরাগী হযরত উমাইর রা. দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন পরলোকে। মৃত্যু সংবাদে হযরত উমর রা. এর মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি হল। তিনি কষ্ট পেলেন। রহমতের দোআ করলেন। তিনি দিগিদিক হয়ে ছুঁটতে লাগলেন। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত হযরত উমাইর রা.-এর কবরের নিকট। দাঁড়িয়ে দোআ করতে লাগলেন।

আশপাশের লোকজনকে লক্ষ্য করে আক্ষেপের সুরে বললেন, তোমাদের প্রত্যেকে নিজের কাঙ্ক্ষিত অভিলাষ প্রকাশ করুন। জনৈক ব্যক্তি বলে উঠল, আমার মনের বাসনা, যদি থাকতো আমারা কাছে রাশি রাশি ধনসম্পদ! খরচ করতাম আল্লাহ ত’আলার রাস্তায়! আরেক জন বলল, যদি আমার কাছে এমন এমন জিনিস পেতাম! শেষ পর্যায়ে হযরত উমর রা. বললেন, আমার মনের একান্ত বাসনা, যদি আমি পেতাম উমাইর ইবনে সা’দ রা. মতো কিছু (মহাসাধক) লোক! যাঁদেরকে আমি মুসলিম জনগণের প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় কাজে নিযুক্ত করতে পারতাম।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর শাসনামলে হযরত উমাইর ইবনে সা’দ রা. হিজরী ২০ সালের দিকে মারা যান।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it