আবূ হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৫৯ হিজরী : ৬৭৯ খৃস্টাব্দ)

যাঁর হৃদয়ে ছিল একটি চেরাগ। রাসূলে আকরাম ﷺ-এর বাণীর আলোয় যে চেরাগটি ছিল দীপ্তিমান ও আলোকিত। যাহিদ ও দুনিয়াত্যাগীদের শীর্ষে যাঁর নামটি ইতিহাসের সোনার আখরে লিখা ছিল। পরহেযগারি ও দুনিয়ামুখিতা যে ব্যক্তিত্বে প্রতিযোগিতা করতো। দুনিয়ার দেয়ালে লেগে ছিল যাঁর যুহদ। জাগতিক মোহ যাঁকে স্পর্শ করেনি। যাঁর স্বভাব ও প্রকৃতিতে ছিল সময়ের পূর্ণ জ্ঞান। তিনি আব্দুর রহমান ইবনে সাখর আদ্দাওসী। বংশগতভাবে ছিলেন দাওস গোত্রের। এতিম ও অনাথ অবস্থায় বেড়ে ওঠেছিলেন। দুর্বল ও অসহায় ছিলেন জীবনের শুরুতে। মদীনায় আগমন করে দেখেন মহানবী ﷺ খাইবার অভিযানে ব্যস্ত। তখন তিনি স্বেচ্ছায় ও পূর্ণমাত্রায় আবেগে মুসলমান হন।

তাঁর জীবন ইয়াকিন ও ধ্রুববিশ্বাসের উষ্ণতায় রঙিন ছিল। হৃদয়ে ছিল ইলম ও জ্ঞানের ভাণ্ডার। সাহাবা কেরামের মাঝে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী। মহানবী ﷺ-এর সাহচর্যধন্য সাহাবা কেরামের মাঝে তিনি ছিলেন শীর্ষে। ছায়ার ন্যায় রাসূলে আকরাম ﷺ-এর সাথে লেগে থাকতেন সর্বদা। নবীজী ﷺ যেখানে আবূ হুরায়রা রা.ও সেখানে। তাঁর ছিল সংবেদনশীল শ্রবণশক্তি, আত্মস্থকারী হৃদয়, সুদৃঢ় বিশ্বাস ও অনুভূতিপরায়ণ বোধশক্তি।

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাঁকে বাইরাইনের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোমলতা ও ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ততার দরুন সেই গুরু দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। গোটা জীবনটা নামায-রোযা, যুহদ ও জিহাদে পরিপূর্ণ। দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ততা যাঁর হৃদয়ে মিশে গিয়েছিল। প্রবৃত্তি ও খাহেশাতে তাড়িত হননি কখনও। রোযা ছিল আত্মার পুষ্টি ও হৃদয়ের পরশমণি।

সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. বলেন, হযরত আবূ হুরায়রা রা.-কে দেখেছি যে, তিনি বাজার ঘুরে বাসায় এসে বলতেন, তোমাদের নিকট কোন খাবার আছে? তারা যদি না থাকার কথা বলতেন, তিনি বলতেন, তাহলে আমি রোযাদার। মেহমানের আতিথ্য পছন্দ করতেন। লোকদেরকে আহার্য দেওয়া পছন্দ করতেন। জনৈক ব্যক্তি বলেছে, ছয়মাস ধরে মদীনায় হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর মেহমান ছিলাম। সাহাবা কেরামের মাঝে হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর মতো অন্য কাউকে এমন দেখিনি। তিনি অতিথিকে অধিক আতিথ্য করতেন। মেহমানদারিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

হযরত উসমান আন্নাহদী রহ. বলেন, এক সপ্তাহ যাবৎ আমি হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর মেহমানদারি করেছিলাম। তিনি, তাঁর স্ত্রী ও খাদেম মিলে পালাক্রমে সারা রাত জেগে নামায পড়তেন। এক জন রাতের এক-তৃতীয়াংশ জাগতেন। প্রত্যেকে জেগে ইবাদত-বন্দেগী করে অন্যজনকে জাগিয়ে দিতো।
হযরত আবূ হুরায়রা তাঁর মেয়েকে উপদেশ দিয়েছিলেন, মেয়ে! সোনালী কাপড় পরিধান করো না। জাগতিক কোন বিষয় নিয়ে মজে থাকা আমি তোমার জন্য ক্ষতির কারণ মনে করি। রেশম ও সিল্কের কাপড় পরবে না। এতে আমি তোমার জন্য অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা করি। জনৈক ব্যক্তি মদীনা শরীফে একটি বাড়ি বানিয়েছিল। বাড়ি নির্মিত হওয়ার হযরত আবূ হুরায়রা রা. সেই বাড়ির পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে বাড়িওয়ালা তাঁকে বলল, আবূ হুরায়রা! আমার বাড়ির গেইটে কী লেখা যায়? হযরত আবূ হুরায়রা রা. বললেন, গেইটে একথা লিখে দাও, ‘বিরান হওয়ার জন্য নির্মাণ করি, মৃত্যুর জন্য জন্মাই, ওয়ারিসের জন্য সঞ্চয় করি।’ জনৈক যাযাবর এ কথা শোনে চেঁচিয়ে ওঠল, শাইখ! আপনি যে বড় মন্দ কথা বললেন! বাড়িওয়ালা বলল, হে আল্লাহ রাসূলের সাহাবী আপনি বড় কথা বলে ফেললেন!

হযরত আবূ হুরায়রা রা. এর বিনয়, জাগতিক নির্লিপ্ততা এবং পার্থিব শান-শওকতের অসারতা ব্যাপারে একটি গল্প আছে যে, তিনি একবার বাজার থেকে পিঠে বহন করে এক গাঁটরি লাকড়ি নিয়ে আসলেন। তখন তিনি মারওয়ান ইবনুল হাকাম এর পক্ষ থেকে মদীনার আমীর। তিনি লাকড়ির গাঁটরি বহন করে চলেছেন, লোকজন দেখে বললেন, আমীরের জন্য রাস্তা ছেড়ে দাও। তাঁর অবস্থা দেখে কেউ একজন বলে ওঠল, আল্লাহ তাআলা আপনার সংশোধনের জন্য এটাই যথেষ্ট।

একবার হযরত আবূ হুরায়রা রা. ফিলিস্তিন আসলেন। লোকজন চাপাতি (পাতলা রুটি) নিয়ে আসল। যখন সেই রুটি তাঁর সামনে খাওয়ার উদ্দেশ্যে রাখা হল তিনি দেখে কাঁদতে লাগলেন। জিজ্ঞাসিত হলেন, কেন কাঁদেন? তিনি বললেন, নবীজী ﷺ সারা জীবন এমন রুটি চোখেও দেখেননি। (একবার) হযরত আবূ হুরায়রা রা. রোগশয্যায় বসে বসে কাঁদলেন। কেউ জিজ্ঞেস করলো, কেন কাঁদেন? তিনি বললেন, তোমাদের এই দুনিয়ার জন্য কাঁদছি না। আমি তো কাঁদছি আমার সফরের দূরত্ব ও পাথেয় স্বল্পতার দরুন। আমি এখন জান্নাত ও জাহান্নামের অতি উচ্চতায় ও শিখরে অবস্থান করছি। জানি না কোনটা আমাকে গ্রাস করে। হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তাঁর নিকট আসলেন মারওয়ান। তিনি বললেন, হে আবূ হুরায়রা! আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করুন। হযরত আবূ হুরায়রা রা. বললেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার সাক্ষাত পছন্দ করি। আপনিও আমার সাক্ষাত পছন্দ করুন। মারওয়ান যখন বেরিয়ে গেলেন তখনই বেজে ওঠল বিদায়ের ঘন্টা। হযরত আবূ হুরায়রা রা. হাসিমুখে আলিঙ্গন করলেন মৃত্যুর সাথে। তিনি হাত মেলালেন মওতের সঙ্গে। সমাদৃত হল শেষ বিদায়। হিজরী ৫৯ সালে তিনি চলে গেলেন জগত-সংসার ছেড়ে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। জান্নাতুল বাকীতে তিনি সমাহিত হন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it