আবূ যর গিফারী রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৩২ হিজরী : ৬৫৩ খৃস্টাব্দ)

হৃদয় কুঠরি যিকিরে পরিপূর্ণ, আল্লাহর স্মরণে আলোকিত। মহানবী ﷺ নবী হিসেবে প্রেরিত হওয়ার আগেই যিনি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করেছিলেন। ঈসা আলাইহিস সালামের যুহদ ও সাধনা যে দেখতে চায় সে আবূ যর গিফারীকে দেখুক। পরিণামে ভঙ্গুর বাড়িঘর তিনি বানাননি। কথা দিয়ে যিনি যুহদ ও দুনিয়া বিমুখিতার শ্লোগান বানিয়েছেন। অল্পতুষ্টি দিয়ে নিজের অন্তরকে পরিপূর্ণ করেছিলেন। ইয়াকীন ও পূর্ণ আস্থায় যাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল। প্রধান মুত্তাকী। ইলম ও আমলের কিংবদন্তি। সাহাবা কেরামের মধ্যমণি। তিনি জুনদুব বিন জুনাদাহ আল্গিফারী। প্রথম ও অগ্রবর্তী সাহাবাদের একজন। রাসূল মনোনীত ব্যক্তিবর্গের একজন। প্রবীণ মুসলমান। মহানবী ﷺ-এর খাদেম। মুসলমান হয়ে নিজের গোত্রের মাঝে ছিলেন। বদর ও উহুদ প্রান্তরের সমর অভিযান পর্যন্ত আপন গোত্রে অবস্থান করেছিলেন। পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতেন। সততায় উপমা ও দৃষ্টান্তব্যক্তি ছিলেন। যিনি সর্বপ্রথম নবীজীকে ইসলামের অভিবাদন জানিয়েছিলেন। তাঁর গোত্র তাঁর মুসলমান হয়েছিলেন। সত্যবাদী ও সত্যপরায়ণ ছিলেন। বাতিলের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। মহানবী ﷺ-এর ইন্তেকালের পর সিরিয়ার গ্রামাঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি দামেস্কে ছিলেন।

অতি মহৎ ও সদাশয় ছিলেন। কমবেশি কোন সম্পদ সঞ্চয় করা বৈধ মনে করতেন না। তিনি দীনদরিদ্র লোকজনকে ধনীদের অর্থকড়িতে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাতেন। তিনি হযরত উসমান রা. নিকট মুয়াবিয়া রা.এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে উসমান রা. হযরত আবূ যর গিফারী রা.-কে মদীনা ডেকে নিয়ে আসেন। তখন থেকে আমৃত্যু তিনি মদীনা শরীফের অদূরে ‘রাবাযা’ নামক ছিলেন।

মহানবী ﷺ মর্যাদার ব্যাপারে বলেছিলেন, (অনুবাদ) আবূ যর অপেক্ষা কোন সত্যবাদীকে নীলিম আকাশ কাউকে ছায়া দেয়নি এবং ধুলার পৃথিবী কাউকে বহন করেনি। (তিরমিযী, হাদীস : ৩৮০১)। হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেছেন, ইলম ও জ্ঞান পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হল আবূ যর। হযরত আবূ বকর রা. বলেছেন, ঈসা আলাইহিস সালামের যুহদ ও সাধনা যে দেখতে চায় সে আবূ যর গিফারী.-কে দেখুক।
হযরত আবূ যর রা. নিজের জবানকে ফেতনা-ফাসাদের জুলমাত ও অন্ধকার তিরোহিত করার মিম্বার বানিয়েছিলেন। তিনি লোকজনকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। তিনি চেঁচিয়ে বলতেন, আমি তোমাদের কল্যাণকামী ও শুভানুধ্যায়ী। কবরের নিঃসঙ্গতা দূর করতে রাতের আঁধারে নামায আদায় করো। কেয়ামত দিবসের গরমের তীব্রতা দূরীভূত করতে পৃথিবীতে সিয়াম সাধনা করো। কষ্টকর দিনের আশঙ্কায় দান-সাদকা করো।

নিজেকে নিয়ে পুরোপুরি পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। সর্বদা নিজেকে তিরস্কৃত করতেন। আপন মনে জাগাতেন খোদাভীতি। বলতেন, আমার মনোবাসনা, আমি যদি কর্তিত বৃক্ষলতা হয়ে যেতাম! আমি যদি সৃজিত না হতাম! মনে দাগ কাটতো। চেষ্টায় লেগে থাকতেন। রাতের ঘোর অন্ধকারে যিকির করতেন। দিনের বেলায় সিয়াম সাধনা করতেন। জাগতিক আরাম-আয়েম, ভোগ-বিলাস আর অর্থকড়ি পসরা সাজিয়ে এসেছিলো তাঁর কাছে; কিন্তু নিজেকে সবসময় সাধনায় দগ্ধ করেছেন। সিরিয়ার রাষ্টপ্রধান হাবীব বিন মাসলামা তিনশত দিনার দিয়ে হযরত আবূ যর রা. এর নিকট মধ্যাহ্নের সময় পাঠালেন। বললেন, আপনার প্রয়োজনে এগুলো খরচ করুন। হযরত আবূ যর রা. বাহককে বললেন, এগুলো তাঁর নিকট ফেরত নিয়ে যান। তিনি কি আমার চেয়ে ভালো মানুষ পায়নি? কসম! আত্মগোপনের জন্য একটু ছায়াই যথেষ্ট। সামান্য কিছু ছাগল দিয়ে জীবনযাপন চলছে। কাজের লোক আছে খেদমতের জন্য। পরিধানের জন্য সামান্য বস্ত্রসামগ্রী রয়েছে। আশঙ্কা হয়, প্রয়োজনের অতিরিক্তের জন্য পরকালে জবাবদিহি করতে হবে।
একদিন হযরত আবূ যর রা. আবুদ্দারদা রা. নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন। তখন তিনি বাড়ি নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত। লোকজন দিয়ে পাথর উঠাচ্ছেন। আবূ যর রা. তাঁকে বললেন, এটা কী? আপনি বাড়ি বানাচ্ছেন যেখানে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ হচ্ছে বিধ্বস্ত করা? আপনাকে আমি যে অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি এর চেয়ে আমার ভালো লাগতো যদি অতিক্রম করার সময় আপনাকে ময়লায় লুটোপুটি খেতে দেখতে পেতাম!!!

বহুদিন দেখা নেই আবূ মূসা রা.-এর বন্ধু আবূ যর রা.-এর সাথে। দীর্ঘ দিন পর সাক্ষাত হওয়ামাত্র আবূ মূসা রা. দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন। দোস্ত অনেক অনেক মোবারকবাদ! কেমন আছো….কিন্তু আবূ যর রা. কেমন অচেনা ভাব দেখিয়ে বললেন, আমি তোমার বন্ধু ছিলাম যখন তুমি নেতৃত্ব গ্রহণ করোনি। আমীর হওয়ার পর তোমার সাথে আমার কোন বন্ধুত্ব নেই। (নেতৃত্ব তাঁর খুব অপছন্দ ছিল)

জনৈক ব্যক্তি হযরত আবূ যর রা.-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলো, আবূ যর! আপনি যখন লোকদের সাথে বসেন তারা আপনার সঙ্গ ছেড়ে চলে যায় কেন? তিনি বললেন, এর কারণ হল, আমি তাদেরকে অর্থকড়ি সঞ্চয় করতে বারণ করি। হযরত আবূ যর রা.-এর কষ্টকর জীবনের প্রভাব তাদের পরিবারকে বিষিয়ে তুলেছিল। যার কারণে তাঁর আম্মা জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে তাঁর এই অবস্থানকে নিন্দা করতেন। আবূ যর রা. বলতেন, মা, আমাদের সামনে দুর্গম একটা গিরিপথ রয়েছে। যার বোঝা হালকা হবে তার জন্য সেই কষ্টসাধ্য পথ অতিক্রম সহজ হবে। একবার আবূ যর রা.-কে বলা হল, অন্যান্য লোকজন যেভাবে জমিজিরাত খরিদ করছে আপনি তেমনটা গ্রহণ করেন না কেন? তিনি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, আমীর হয়ে আমার কী লাভ? আমার তো প্রত্যহ সামান্য দুধ বা পানি এবং সপ্তাহে এক কাফীয (১৬ কেজি) গমইযথেষ্ট । একদিন তিনি লোকজনকে ওয়াজ-উপদেশ দিচ্ছেন, তাদেরকে অর্থসম্পদ সঞ্চয় করতে বারণ করছেন। তিনি বললেন, তোমাদের কারো নিকট যেন এক দিনার বা এক দেরহাম কিংবা সোনারুপা একদিনের বেশি গচ্ছিত না থাকে। তবে আল্লাহ রাস্তায় খরচ করা বা কোন উত্তমর্ণকে (ঋণদাতা) কোন ওয়াদা দিয়ে থাকলে সেটা ঠিক আছে।

একবার হযরত মুয়াবিয়া রা. চাইলেন আবূ যর রা.-কে পরখ করবেন। তিনি তাঁর নিকট রাতের আঁধারে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাঠালেন। আবূ যর রা. সেই একহাজার স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে খরচ করে ফেললেন। মুয়াবিয়া রা. ফজর নামায পড়িয়ে দূতকে ডাকলেন। বললেন, আবূ যরকে বলো সেই এক হাজার দিতে। কারণ সেটা মুয়াবিয়া রা. ভুলে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আবূ যর রা. বললেন, বৎস! মুয়াবিয়াকে বলো, আবূ যর আপনাকে বলছে, কসম! আমার কাছে এক দিনারও নেই। আমাকে তিনদিন সময় দিতে বলেন, আমি সেগুলো যোগাড় করে দিবো।

আবূ যর রা. দ্রুত সময়ে ইন্তেকাল করেছিলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় পতিত হলে তাঁর স্ত্রী কাঁদতে লাগেন। তিনি রুদ্ধ কণ্ঠে তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তুমি কেন কাঁদছো? তাঁর স্ত্রী উত্তরে বললেন, আপনাকে কাফন দেওয়ার মতো আমার সামর্থ্য নেই। আপনারও এমন কোন কাপড় নেই যা কাফনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে। তিনি ঈমান ও বিশ্বাস নিয়ে বললেন, কান্নাকাটি করো না। কারণ নবীজী ﷺ এমন কিছু লোককে বলেছেন, তাঁদের মধ্যে আমিও আছি, ‘তোমাদের থেকে একজনের মৃত্যু হবে জনমানবহীন প্রান্তরে। যা প্রত্যক্ষ করবে মুমিনের একটি দল।’ আমি ছাড়া তাঁদের সবাই লোকালয়ে মারা গেছে। আমি মারা যাচ্ছি মরুপ্রান্তরে। তিনিও ভুল বলেননি আর আমিও ভুল বলিনি। তাই তুমি পথের দিকে চেয়ে থাকো। তিনি হতাশ হয়ে বললেন, কীভাবে সম্ভব এই মরুপ্রান্তরে! এখন তো হাজীদের বিচরণও শেষ। তিনি টিলার উপর ওঠে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন। একবার স্বামীর খেদমতে আবার মুসাফির দেখতে টিলার উপর হাজিরি। ইতোমধ্যে বাহন নিয়ে কাফেলা যাচ্ছে এই পথ ধরে। তিনি কাপড় দিয়ে ইঙ্গিত করলেন। তারা দেখে এগিয়ে আসল। তারা বলল, কী ব্যাপার? তিনি বললেন, একজন মুসলমান মারা যাচ্ছেন। তোমরা তাঁর কাফনের ব্যবস্থা করো। তারা বলল, লোকটি কে? বললেন, আবূ যর। তারা গিয়ে দেখে তিনি মরণাপন্ন। তাদেরকে আবূ যর রা. বললেন, আমার কাফন পরিমাণ কাপড় যদি আমার বা আমার স্ত্রীর থাকতো, আমি সেই কাপড় নিয়েই সমাহিত হতাম। তোমাদেরকে আল্লাহ এবং ইসলামের দোহাই দিয়ে বলি, আজ আমার কাফনের কাপড় এমন কেউ দিবে না যে আমীর বা গোত্রপ্রধান কিংবা দূত। এরপর দেখা গেল, কাফেলার প্রায় সবার অবস্থা তাঁর কথার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অবশেষে একজন আনসারী যুবক পাওয়া গেল। সে বলল, চাচা, আমি আপনাকে কাফন দিবো। আপনি যেসব কথা বলেছেন সেগুলোর কোনটাই আমার মাঝে নেই। এখন আমার গায়ে যে চাদরটা রয়েছে সেটা দিয়ে আপনাকে কাফন দিবো। আরও আছে এই দু’টি কাপড়। যা আমার আম্মা আমার জন্য নিজ হাতে বয়ন করেছেন। শেষ পর্যন্ত এই আনসারী যুবক হযরত আবূ যর রা.কে কাফন দিয়েছিলেন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it