আবূ উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ১৮ হিজরী : ৬৩৯ খৃস্টাব্দ)

ফেরেশতা দীক্ষিত ব্যক্তি। নিজে জান্নাতে পৌঁছার আগেই তাঁর দন্তদ্বয় স্থান করে নেয় সেখানে। তিনি প্রধান সেনাপতি। দেখলে তুমিও করুণা বোধ করতে। একহাতে দান করতেন প্রচুর। দান করে দীনদুঃখী লোকদের আনন্দ দিতেন। আরেক হাতে শত্রুবাহিনীর অন্তরে ছড়িয়ে দিতেন ভীতি। তিনি এই উম্মতের বিশ্বস্ত ব্যক্তি। সিপাহসালার, প্রধান কমান্ডার। আমির ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনুল র্জারাহ কুরাইশী। সিরিয়া বিজয়ী। ওহীর সংবাদের ভিত্তিতে যিনি দশজন সৌভাগ্যবান জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবীদের একজন। প্রবীণ সাহাবী। ইসলামের সকল সমর অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আবিসিনিয়ায় দু’বার হিজরত করেছিলেন।

উহুদ প্রান্তরে জীবনবাজি রেখে যারা লড়াই করার শপথ নিয়েছিলেন তিনি তাদের একজন। দৃঢ়পদে লড়েছেন নবীজীর ﷺ-এর সাথে। তিনিই উহুদ যুদ্ধে দাঁতে কামড় দিয়ে নবীজী ﷺ-এর মুখমণ্ডলের শিরোদেশ থেকে ফলক বের করেছিলেন। এতে তাঁর দু’টি দাঁত পড়ে যায়। এভাবে দাঁত ভেঙে তিনি শ্রেষ্ঠ মানুষের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। হযরত আবূ বকর রা. তাঁকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দায়িত্ব দেন। অপর দিকে হযরত উমর রা. তাঁকে সিরিয়া অভিযানের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি দুই সন্তানের জনক। অবশ্য তাঁর জীবদ্দশায় তারা মারা যায়। এভাবে তিনি অবশেষে নিঃসন্তান হয়ে যান।

নবীজী ﷺ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, (অনুবাদ) প্রত্যেক উম্মতের একজন আমীন-বিশ্বস্ত লোক রয়েছে। আর এই উম্মতের আমীন ও বিশ্বস্ত লোক হল আবূ উবাদাহ ইবনুল র্জারাহ। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৬৪০৫; তিরমিযী, হাদীস: ৩৭৯১)। একদিন হযরত উমর রা. তাঁর সভাসদ লোকদেরকে বললেন, তোমরা সবাই নিজেদের অভিলাষ অনুসারে আকাক্সক্ষা করো। সবাই যার যা তামান্না তাই আকাক্সক্ষা করলো। পরক্ষণে উমর রা. বললেন, আমার তামান্না এমন একটি ঘর যেখানে আবূ উবাইদা ইবনুল র্জারাহ’র মতো লোকে লোকারণ্য।
হযরত আবূ উবাইদা রা.-এর বিনয় ও দুনিয়া বিমুখতার নমুনা এমন ছিল যে, তিনি বলতেন, আমার জানা মতে সাদা কিংবা কালো, স্বাধীন কিংবা পরাধীন সবাই তাকওয়া ও পরহেযগারিতে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তবে তাদের মতো আমিও হতে চাই।

একবার উমর ইবনুল খাত্তাব রা. সিরিয়া থেকে আসলেন। লোকজন এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় মানুষ তাঁর সাথে দেখা করতে আসল। উমর রা. বললেন, আমার ভাই কোথায়? লোকজন বলল, কে? তিনি বললেন, আবূ উবাইদাহ। তারা বলল, এখনই তিনি আসবেন। যখন তিনি আসলেন হযরত উমর রা. নেমে কোলাকুলি করলেন। উমর রা. প্রস্তাব করলেন, আমাদের নিয়ে আপনার বাসায় চলেন। যখন উমর রা. হযরত আবূ উবায়দাহ রা.-এর বাসায় প্রবেশ করলেন তখন দেখলেন, তাঁর বাসায় আছে স্রেফ তরবারি, ঢাল ও গদি। উমর রা. বললেন, কোথায় আপনার বিত্তবৈভব? আপনি তো একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। খাবারের কিছু আছে? আবূ উবাইদাহ রা. দাঁড়িয়ে নামিয়ে আনলেন ছোট্ট একটি টুকরি। যেখানে রাখা আছে সামান্য রুটির টুকরা। হযরত উমর রা. কাঁদলেন। বললেন, অন্য বন্ধু-বান্ধবগণ যেভাবে অর্থকড়ির মালিক হয়েছে আপনি তেমনটি কেন গ্রহণ করেননি? তিনি বললেন, আমীরুল মুমিনীন! এগুলো আগামী দিন দুপুর পর্যন্ত চলবে। হযরত উমর রা. চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, আবূ উবাইদাহ! তুমি ছাড়া আমাদের সবাইকে দুনিয়া পাল্টে দিয়েছে।

হযরত আবূ উবাইদাহ রা. ছিলেন উদারতা ও দানশীলতার মূর্তপ্রতীক। যুহদ ও খরচের কিংবদন্তি। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. একটা থলেতে চারশত দিনার দিয়ে কাজের লোককে বললেন, যাও, এগুলো নিয়ে আবূ উবাইদাহকে দিয়ে এসো। লক্ষ্য রাখবে, তিনি এগুলো কী করেন। কাজের লোক নিয়ে চলল এইসব স্বর্ণমুদ্রার থলে। দিলেন আবূ উবাইদাহ রা.কে। বলল, আমীরুল মুমিনীন বলেছেন, আপনার যে কোন প্রয়োজনে এগুলো খরচ করবেন। তিনি মুদ্রাভর্তি থলে নিলেন এবং দোআ দিলেন। পরক্ষণে কাজের বুয়াকে ডাকলেন। বললেন, এখান থেকে সাত দিনার অমুককে দিবে। পাঁচ দিনার অমুককে দিবে। এভাবে বলতে বলতে সবগুলো মুদ্রা দিয়ে দিলেন। কাজের লোক ফেরত এসে হযরত উমর রা. নিকট আবূ উবাইদাহ রা. যেভাবে বিলিয়ে দিলেন তার বিবরণ দিলেন। একথা শোনে উমর রা. প্রশান্ত মনে বললেন, আমহামদুলিল্লাহ, প্রশংসা আল্লাহ তাআলার। তিনি ইসলামে এমন মানুষ রেখেছেন যাঁরা অর্থকড়ির প্রতি লালায়িত নন।

একবার সিরিয়ায় মহামারী মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এমন কোন ঘর ছিল না যেখানে একজন মারা যায়নি। প্রবল মহামারীর ছোবলে প্রচুর প্রাণহানি ঘটে। তখন উমর ইবনুল খাত্তাব রা. আবূ উবাইদাহ ইবনুল র্জারাহ রা.-এর নিকট এই মর্মে পত্র লিখেন, মহামারীর ছোবল থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত সেখান থেকে চলে এসো। হযরত আবূ উবাইদাহ রা. চিঠি পড়ে মন্তব্য করলেন, বুঝতে পেরেছি আমীরুল মুমিনীন চাচ্ছেন এমন লোকদের ধরে রাখবেন যাদের হায়াত ফুরিয়ে গেছে। মৃত্যু-আসন্ন লোকদেরকে তিনি মরতে দিতে নারাজ।

আবূ উবাইদাহ রা. চিঠির উত্তর লিখলেন, আমীরুল মুমিনীন! আমি আপনার প্রয়োজন বুঝতে পেরেছি। অনুগ্রহ করে আমাকে আপনার উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় থেকে মুক্তি দিন। আমি এখন মুসলিম সৈন্যবাহিনীর একজন সৈনিক। তাদের বাদ দিয়ে আমি নিজেকে নিয়ে বিকল্প চিন্তা করতে পারি না। হযরত উমর রা. চিঠি পড়ে কাঁদলেন। তাঁকে বলা হল, আবূ উবাইদাহ রা. মারা গেছেন। তিনি বললেন, না, মারা যায়নি।
এর কিছুদিন পরই হযরত আবূ উবাইদাহ রা. মারা যান। এরপর মহামারী ও প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব শেষ হয়ে যায়। হিজরী ১৮ সালে ‘আমাওয়াস’ প্লেগ ও মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোকে গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it