উপলক্ষ ও সংস্কৃতিকুরবানী

কুরবানী ও কুরবানীর ফযীলত

কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত এবং শাআয়েরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের এমন একটি বিধান যা প্রকাশ্য ও সম্মিলিতভাবে আদায় করা হয়। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরবানীর গুরুত্ব অপরিসীম। শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় শরীয়ত অনুমোদিত কোনো বস্তু আল্লাহর দরবারে পেশ করা এবং শরীয়তের নির্দেশনা অনুাযায়ী তা ব্যবহার করাকে কুরবানী বলে।

হযরত আদম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর যামানা থেকে কুরবানীর ধারা চলে আসছে। সূরা মাঈদার ২৭-৩১ নং আয়াতে আদম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর দুই সন্তানের কুরবানীর কথা এসেছে। তবে প্রত্যেক নবীর শরীয়তে কুরবানীর পন্থা এক ছিল না। সবশেষে কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য প্রেরিত নবী মুহাম্মদ মুস্তফা ﷺ প্রতি যে চিরন্তন শরীয়ত নাযিল হয়েছে তাতে কুরবানীর যে পন্থা নির্দেশিত হয়েছে তা-ই কেয়ামত পর্যন্ত অনুসৃত হবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

○فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

অর্থ: সুতরাং তুমি তোমার রবের জন্য নামায পড় এবং কুরবানী কর। -সূরা কাউসার ১০৮ : ২

এ আয়াতে পূর্ণ তাওহীদ ও ইখলাছের সাথে একমাত্র আল্লাহর জন্য কুরবানী করার কথা বলা হয়েছে। নামায যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য, অন্য কারো নামে হতে পারে না, ঠিক কুরবানীও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে, অন্য কারো জন্য হতে পারে না। অন্য আয়াতে এ বিষয়টি এভাবে রূপায়িত হয়েছে,

قُلْ اِنَّ صَلَاتِىْ وَنُسُكِىْ وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِىْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

অর্থ: আপনি বলে দিন, আমার নামায, আমার ইবাদত-বন্দেগী ও কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপারক। -সূরা আনআম ৬ : ১৬২-১৬৩

সুন্নতে ইব্রাহীম

শরীয়তে মুহাম্মদীতে কুরবানীর যে পন্থা ও পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূলসূত্র ‘মিল্লাতে ইব্রাহীম’ -এ বিদ্যমান ছিল। তাই কুরবানীকে ‘সুন্নাতে ইব্রাহীম’ নামে অভিহিত করা হয়।
‘কুরবানী’ স্মরণ করিয়ে দেয় ইব্রাহীম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস; খলীলে খোদার আল্লাহ-প্রেম, খোদা-ভক্তি, স্রষ্টার আদেশ পালনের জযবা ও ব্যাকুলতা এবং আগ্রহ-উদ্দীপনার এক দাস্তান। এ তো বিনা দ্বিধায়, বিনা চিন্তায় আল্লাহতে লীন ও বিলীন হওয়ার চির উন্নত ও পবিত্র চিত্র। পিতা-পুত্রের অবিস্মরণীয় এ চিরন্তন কাহিনীকে পবিত্র কুরআন অংকন করেছে এভাবে :

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ اِنِّى اَرٰى فِى الْمَنَامِ اَنِّى اَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا اَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِى اِنْ شَاءَ اللّٰهُ مِنَ الصَّابِرِيْنَ ○ فَلَمَّا اَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ ○ وَنَادَيْنَاهُ اَنْ يَا اِبْرَاهِيْمُ ○ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا اِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ ○ اِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِيْنُ ○ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ ○ وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى الْآخِرِيْنَ ○ سَلَامٌ عَلٰى اِبْرَاهِيْمَ ○ كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ ○ اِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِيْنَ ○

অর্থ: যখন ইসমাঈল عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ বাবা ইব্রাহীম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর সাথে চলার বয়সে উপনীত হলেন, তখন ইব্রাহীম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ (আল্লাহর পক্ষথেকে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে) বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নযোগে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি দেখ, কি করবে? (এটা আল্লাহর আদেশ) ইসমাঈল (আ.) তদুত্তরে বললেন, আব্বা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা সম্পন্ন করুন। ইনশাআল্লাহ, অবশ্যই আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন পিতাপুত্র উভয়ই আল্লাহর আদেশ পালনার্থে সম্মত হলেন এবং ইব্রাহীম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ ইসমাঈল عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ-কে জবেহ করার জন্য মাথা কাত করে মাটিতে শায়িত করলেন, অমনি আমি আল্লাহ তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন (আমার আদেশকে) বাস্তবে সত্য পরিণত করে দেখিয়েছ। এভাবেই আমি সৎ কর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল সুস্পষ্ট বিশাল পরীক্ষা। আর আমি ইসমাঈলের পরিবর্তে কুরবানী করার জন্য একটি হৃষ্টপুষ্ট পশু (দুম্বা) পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তীদের মাঝে আমি ইব্রাহীমের সুনাম-সুখ্যাতি ও কাজকে অব্যাহত রেখেছি। ইব্রাহীমের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আমি নেককারদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের একজন। সূরা সাফফাত : ১০২-১১১

আল্লাহ তাঁর খলীলের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য পুত্র ইসমাঈল عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ কুরবানী করার আদেশ করেছিলেন। তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ ইসমাঈল عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -কে রক্ষা করে তার পরিবর্তে কুরবানী হওয়ার জন্য একটি পশুপ্রেরণ করেন। কেয়ামত পর্যন্ত এ-ধারা অব্যাহত থাকবে। এখানে পার্থক্য শুধু জীব মাত্রের। আদেশ এক, তরীকা এক, উদ্দেশ্যও এক। যুগে যুগে খোদা প্রেমিকগণ এভাবেই রবের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার নযরানা পেশ করে যাবেন-

جان دى، دى هوئى اسى كى تھى
حق تو يه هے كه حق ادا نه هوا

‘জান দিয়েছি, কিন্তু এই জান তো তারই দেয়া
আহ! মুহব্বতের দাবী তোমার, হল না যে পূরণ করা।’

ইব্রাহীম عَلَيْهِ ٱلسَّلَامُ -এর এই আদর্শের পূর্ণ রূপায়ন ঘটুক এটাই কুরবানীর পরম লক্ষ্য। আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য অর্জন করে বান্দা প্রকৃত খোদাভীরু ও মুত্তাকী হোক এটাই কুরবানীর মুখ্য উদ্দেশ্য। ইরশাদ হয়েছে,

لَنْ يَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ ـ

অর্থ: কখনই আল্লাহর নিকট পৌঁছে না কুরবানীর গোশত, না তার রক্ত, বরং শুধু পৌঁছে তাঁর নিকট তোমাদের দিলের খোদাভিরুতা ও তাকওয়া। -সূরা হজ্ব ২২ : ৩৭

আনুগত্যের এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ পশু কুরবানী করে নিজের পশুত্বকেও কুরবানী করে দেয়, আর এভাবে সে পশুত্বের স্তর থেকে মনুষ্যত্বের স্তরে উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করে।

হযরত আয়েশা رضي الله عنها থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ  ইরশাদ করেন :

ما عمل ابن آدم من عمل يوم النحر أحب إلى الله من إهراق الدم وإنه ليأتى يوم القيامة بقرونها و أشعارها و أظلافها، و إن الدم ليقع من الله بمكان قبل أن يقع بالأرض، فطيبوابها نفسا ـ

অর্থ: কুরবানীর দিবসে আল্লাহর নিকট কুরবানীর চেয়ে আদম সন্তানের কোনো আমলই অত্যাধিক প্রিয় নয়। কেয়ামতের দিন কুরবানীর পশু নিজের শিং, চুল, পায়ের খুর নিয়ে (আল্লাহর দরবারে) উপস্থিত হবে। আর কুরবানীর পশুর রক্ত যমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মকবুলিয়াতের স্থানে পৌঁছে যায়। সুতরাং হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা মহা আনন্দে দিল খুলে কুরবানী কর।’ -জামে তিরমিযী : ১৪৯৩

হযরত আবু সাঈদ খুদরী رضي الله عنه থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার ফাতিমা رضي الله عنها কে বললেন, ফাতেমা! ওঠ, কুরবানীর পশুর সামনে এসে দাঁড়াও। যমিনে এর রক্তের ফোটা পড়ার সাথে সাথে আল্লাহ তোমার পিছনের গুনাহ মাফ করে দিবেন। ফাতিমা رضي الله عنها জিজ্ঞাসা করলেন, এই সুসংবাদ কি শুধু আহলে বাইত (নবী পরিবারের) জন্য নাকি সকল উম্মতের জন্য? নবীজি ﷺ বললেন, নবী পরিবারের জন্য এবং সকল উম্মতের জন্যও। মাজমাউয যাওয়ায়িদ, মুসনাদে বাযযার : ১২০২

যার উপর কুরবানী ওয়াজিব কিন্তু কুরবানী করে না তার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রা رضي الله عنه থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির কুরবানী করার সামর্থ্য আছে অথচ কুরবানী করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। মুসনাদে আহমদ : ৮২৭৩

Last Updated on June 20, 2022 @ 12:32 pm by IslamInLife

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it