তাবেয়ীন রা:​​

আমার কি উন্নতি হচ্ছে, নাকি অবনতি

ক্ষণস্থায়ী এ পার্থিব জীবনের সংক্ষিপ্ত সময় ফুরিয়ে আসছে। দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। দপ করে নিভে যাওয়া প্রদীপের মত আমাদের জীবনের হায়াতেরও হঠাৎ একদিন অবসান হবে। আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, চাহিদা আর পরিকল্পনার পাহাড় মুহূর্তের মধ্যে চুড়মার হয়ে যাবে!

দুনিয়ার থেকে বিদায়-মুহূর্তটি কেমন হবে আমার? কুরআন ও হাদীস এ বিষয়টিকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়। মানুষ হুঁশিয়ার হও, মানুষ সাবধান হও। মৃত্যু বহু ঝগড়াঝাটির অবসান ঘটায়। বহু গোপন সত্য আর বহু গোপন মিথ্যা ফাঁস করে দেয়।

মৃত্যু মুহূর্তে আমাদের প্রত্যেকের দৃষ্টি তাকিয়ে দেখবে যে, তার রূহ বের হয়ে যাচ্ছে। তখন অসহায় হয়ে দেখব, আমার রূহ শরীর থেকে পৃথক হয়ে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকেই তখন ভালোভাবেই উপলব্ধি করব, আমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি।  আমলের সব সুযোগ এ মুহূর্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কত অসহায় মানুষ। কারোর কিছুই করার থাকবে না তখন।

এজন্য এখন হায়াত ও সুযোগ থাকতে জীবনের মূল্যায়ন করা জরুরি। সব চিন্তা আর কাজকে আখেরাতের প্রস্তুতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা উচিত। দেখা দরকার, আমার উন্নতি হচ্ছে নাকি অবনতি?

গুনাহ ছাড়ছি, তো উন্নতি হচ্ছে; গুনাহ করছি, তো অবনতি হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা ফরমাবরদারির চিন্তা আর ফিকির বৃদ্ধি করছি, তো উন্নতি হচ্ছে। নেক কাজে অলসতা, উদাসীনতা অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গীবত বা অন্যান্য গুনাহ করছি অবাধে, তো অবনতি হচ্ছে। নেককার দ্বীনদারদের ভালোবাসি, তাদের সঙ্গে ওঠা-বসা করছি, তাদের কথায় মনোযোগী হচ্ছি, তাদের উপদেশকে বরণ করছি – তো উন্নতি হচ্ছে। গান-বাজনা, সিনেমা-নাটক, খেলাধুলা, আড্ডা আর বেহায়াপনা করছি – তো অবনতি। গুনাহ করে অস্থির হয়ে যাচ্ছি, তওবা করছি, এইসব ছাড়ার ফিকির আর চিন্তা আমার মনকে তোলপাড় করে দিচ্ছে — এটিও ভালো। গুনাহ হয়ে গেলে তওবা করছি। এটি উন্নতির লক্ষণ। আল্লাহ তাআলার অসীম ও অশেষ মেহেরবানী যে এই অবস্থাটি অনেক ভালো। তওবা জারি থাকলে ইনশাআল্লাহ গুনাহ করার অভ্যাস দূর হবে, একদিন নেক জীবন অর্জিত হবে। আর মৃত্যু যদি তওবারত অবস্থায় চলে আসে, খুব আশা আছে যে, আন্তরিক তওবাকারী বঞ্চিত হবে না ইনশাআল্লাহ।

একটি ঘটনা শুনুন।

শায়খুল মাশায়েখ, অন্যতম তাবেয়ী, বসরার আবেদ, উম্মুল মুমিনীন رضي الله عنها -এর পবিত্র দুধ পানকারী তাবেয়ী হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহের সময়কার ঘটনা। উনার তো অনেক শাগরেদ ছিল। মহিলা মুরীদ/শাগরেদও ছিল। এক নেককার মহিলা তার শাগরেদ ছিল। সেই পুণ্যবতী মহিলা পর্দার সঙ্গে দ্বীন শিখত শায়খ হাসান বসরী رحمة الله عليه -এর কাছে। তার এক পুত্র সন্তান ছিল, ছোট। সেই অবস্থায় তিনি বিধবা হয়ে যান, স্বামী দুনিয়া থেকে চলে যায়। মহিলা সন্তানের চিন্তা করে বিয়ে করেননি। সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করেন। কিন্তু হায়! সেই সন্তান বড় হয়ে আল্লাহ তাআলার নাফরমানিতে লিপ্ত হয়।  হাসান বসরী رحمة الله عليه তাকে বোঝাল, মাও তাকে অনেক বোঝাল। কে শুনে কার কথা? দুনিয়ার মোহ, নগদের টান, লোভ-লালসা সেই যুবককে একেবারে বল্গাহীন জীবনযাপনে ডুবিয়ে দিল। বারবার তাকে বিভিন্নভাবে বোঝানোর পরও যখন ফল হল না, হাসান رحمة الله عليه চিন্তায় পড়লেন, ছেলেটার অন্তর  সীমাহীন গুনাহে আচ্ছন্ন হয়ে সীলমোহর অঙ্কিত হয়ে যায়নি তো! মা তার ছেলেকে নিয়ে বেচায়েন (অশান্ত)। আখেরাতে তার ছেলের কী হবে?! ছেলে যে পথহারা…

এত গুনাহ, এত নাফরমানি, এত সীমালঙ্ঘন – একটা মাত্রা তো আছে। গুনাহ করতে করতে সেই যুবকের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেল। এমনকি সে বিছানায় পড়ে গেল। তারপর অবস্থা এতই খারাপ হল যে, ডাক্তার বলে দিল তার জীবনের আশাই শেষ।

হায়! মা-তো এবার মহাভাবনায় পড়ে গেল। কী হবে এখন? তার ছেলের কি তওবা নসিব হবে না? এই অবস্থায় মৃত্যু আসবে? হে আল্লাহ! তুমি রাস্তা খুল, ব্যবস্থা কর। মায়ের বুকে হাহাকার। বান্দা নিজে না ফিরে এলে আল্লাহ তাআলার কী ঠেকা? ছেলেকে আবার বোঝালো, বাবারে তওবা কর্। ফিরে আয়। ছেলে তাজ্জব। তওবা? এই – এখন? যখন সব শেষ? আচ্ছা মা, এখন তওবা করলে হবে? কোনো উপায় আছে? মা বলল, হ্যাঁ – অবশ্যই। আমার শায়েখকে জানাই, সে একটা পথ বাতলে দিবে। তাকে এখানে আসতে বলব। চরম উত্তেজনা মায়ের মধ্যে। আশার টিম টিম আলো যেন সূর্যের খবর দিচ্ছে। ছেলে বলল – আমিতো উঠতেই পারি না। হাসান কি আসবেন আমার কাছে? আচ্ছা মা, যাও শায়েখের কাছে। জেনে নাও তার কাছে; আর যদি তুমি এসে দেখ আমার দম চলে গেছে, শায়খকে বল আমার জানাযা পড়াতে।

বিশাল আশা-ভরসার পাহাড় নিয়ে ব্যাকুল হয়ে মা শায়খ হাসান رحمة الله عليه -এর দরজায় করাঘাত করলেন। শায়খ! আমার ছেলে তওবার এরাদা করেছে। আপনি আসুন। শায়খ হাসান দ্বীনী কাজের ব্যস্ততার কারণে ক্লান্ত-শ্রান্ত। তখন একটু আরামে…………শুনে তিনি তো অবাক। যার পিছনে এত সময়, এত শ্রম দেওয়া হল, সে কী আন্তরিক কথা বলছে…..? ছেলের মা তাকে বোঝালেন, জানাযার অসিয়তের কথাও বললেন। শায়খ হাসান رحمة الله عليه এমন মানুষের জানাযা পড়াতে অস্বীকার করলেন। কারণ সে প্রকাশ্যে নামায তরককারী ছিল (এটা অনেক আল্লাহওয়ালাগণের নিয়ম, যেন অন্যান্যদের জন্য বিরাট শিক্ষা হয়। কারণ তাতে মানুষ ভীত হবে)। যুবকের মায়ের দুঃখ সেদিন আল্লাহ তাআলা তো বুঝেছেন।

মায়ের মাথায় যেন আসমান ভেঙ্গে পড়ল! শায়খ হাসানকে তিনি আনতে পারলেন না। ছেলের কাছে হতাশ হয়ে ফিরে আসলেন। ছেলে তখনো হায়াতে। মায়ের চেহারাই হয়ত অনেক জবাব দিয়ে দিয়েছিল তাকে। মায়ের কাছে শায়খ হাসানের কথোপকথন শোনার পর আজীব কথা নিঃসৃত হল তার জবান থেকে। আমার লাশটা তোমার ওড়না দিয়ে আমার গলায় পেঁচিয়ে রাস্তায় টেনে হেঁচড়ে তারপর এই বারান্দায় দাফন করে দিও মা। কবরস্থানে আমাকে কবর দিয়ে অন্যান্য কবরবাসীদের কষ্ট দিও না। রূহ তার বের হয়ে গেল। মা তার ছেলের প্রস্থানে ব্যথিত, দুঃখে আর শোকে ভারাক্রান্ত।

কিছুক্ষণ পরই দরজায় করাঘাত। দরজা খুলতেই মা দেখেন শায়খ হাসান বসরী رحمة الله عليه দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার! সমগ্র দুনিয়া যদি না চায় কিন্তু আল্লাহ তাআলা যদি চান?!

বিশ্রাম নিতে গিয়ে হাসান বসরী رحمة الله عليه শুনেছেন এক ঘোষণা – এক মুসলমানের জানাযা তুমি পড়াতে পারবে না হাসান? তুমি কেমন ওয়ালী (বন্ধু) আমার?!

আর দেরি নয়। শায়খ হাসান সব বুঝে ফেললেন। হ্যাঁ – হ্যাঁ, সেই যুবকের তওবা কবুল হয়ে গেছে! আমি তার জানাযা পড়াতে নির্দেশিত।

গায়েবী ইশারায় নির্দেশিত হয়ে শায়খ হাসান বসরী رحمة الله عليه পড়িয়েছেন সেই তওবাকারী যুবকের জানাযা।

অতএব পাঠক। আসুন আমি আর আপনিও…….

আল্লাহ তাআলা আমাদের কবুল করুন। আমীন।

Last Updated on September 15, 2022 @ 11:16 am by IslamInLife

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it