নেক কাজে দৃঢ়তা বৃদ্ধির উপায়: ৪
লেখাটি দীর্ঘ করতে চাইনি! কোনো মুখলেস পাঠকের জন্যেই কি লেখাটি একটু বড় হয়ে গেল, নাকি নিজের নফসের চাহিদার মিশ্রণের কারণে – জানি না। প্রথমটি হলে তো নাজাতের জন্য বড় ‘যাখিরা’ (সম্পদ)। আর দ্বিতীয়টি হওয়ারও আশঙ্কা আছে, তাই ক্ষমা চাইছি….
নেক কাজে দৃঢ়তা অর্জনের জন্যে অাল্লাহ তাআলাকে খুব বেশি স্মরণ (অর্থাৎ তাঁর যিকিরে) এবং তাঁর কাছে অনেক বেশি দোআ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
আল্লাহ তাআলা’র স্মরণ ও দোআ স্বতন্ত্র ইবাদত তো বটেই, আবার সব ইবাদতের মাঝে এগুলো বিদ্যমান। সব ইবাদতের এগুলো অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অন্য সব ইবাদতের একটি সীমা নির্ধারিত আছে যা কমপক্ষে আদায় করলে হয়। কিন্তু ‘যিকরুল্লাহ’ বা আল্লাহ তাআলা’র স্মরণ এবং দোআ’র না কোনো সীমা বেঁধে দেয়া আছে, না সময়। বরং তাগিদ হল উভয়টিই যত বেশি করতে পার কর।
‘আল্লাহ তাআলা’র স্মরণ বা যিকির’ অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। মুমিনের সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল – প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস মাওলার স্মরণ (যিকিরের) জন্যে। পবিত্র কুরআনে যিকির ‘কাসরাত’ অর্থাৎ খুব বেশি করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। যিকির বা আল্লাহ’র স্মরণ খুব বেশি করার ফলে কী হবে? এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে লাভের যে অসংখ্য বর্ণনা ও সুসংবাদ ঘোষিত হয়েছে তা এক কথায় বলতে গেলে বলতে হবে (অধিক যিকিরের লাভ হল:) পার্থিব ও পরকালীন সকল কল্যাণ অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ!
নেক কাজে দৃঢ়তা বৃদ্ধির এত সহজ ও মজবুত রূহানী হাতিয়ার আর নেই। মুমিন যদি কল্যাণের পথে অতি সহজে, খুবই দ্রুত অগ্রসর হতে চায় তাহলে তার উচিত নিজের উপর আল্লাহ পাকের স্মরণ বা ‘যিকির’কে লাযেম (আবশ্যকীয়) করে নেয়া। শুরুতে কম হোক, কিন্তু প্রতিদিন নির্ধারিত পরিমাণ বা নির্ধারিত সময় কিছু যিকির করা আমাদের সবার উচিত। এটা প্রাথমিক কাজ। লক্ষ্য এটাই হবে যে, এই যিকিরের মাধ্যমে আমার উঠা-বসা, চলা-ফেরা সর্বক্ষণ ‘আল্লাহকে স্মরণ’ এবং তাঁর সাথেই সবচেয়ে গভীর সম্পর্ক স্থাপন।
পবিত্র সত্ত্বার যিকিরই আমাদের অন্তরকে ‘কুদরতি’ ভাবে পবিত্র করে। ফলে যে শক্তি ও দৃঢ়তা অন্তরে সৃষ্টি হয় তা পাহাড় থেকেও মজবুত! নেক কাজে অবিচল থেকে হায়াতের সর্বোচ্চ কার্যকারিতা ও সুফল তখনই বাস্তব রূপ নেয়। মুমিনের পক্ষে ভুল-ত্রুটি-গুনাহ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যিকিরের মাধ্যমে মুমিন নিজেকে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখার প্রয়াস পায়। আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে তাকে গায়েবী (অদৃশ্য জগতের) সাহায্য করা হয়।
এটা নেহায়েত আল্লাহ পাকের দয়া ও দান যে তিনি আমাদের জীবনের সব অবস্থাকে তাঁর হুকুম মানার শর্তে যিকির হিসেবে কবুল করেছেন।
মুমিনের যিকির কখনো প্রকাশ পায় কাজের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠের মাধ্যমে। কখনো তাসবীহ, তাহলীল বা তাকবীর পাঠের মাধ্যমে। কখনো তেলাওয়াত, কখনো বা দোআ পাঠের মাধ্যমে। কখনো সবর, কখনো শোকর আদায়ের মাধ্যমে। কখনো সৎ কাজের আদেশ অথবা অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে। কখনো হারাম থেকে বাঁচার মাধ্যমে। কখনো নামায, রোযা, বা কখনো ‘খেদমতে খালক্’ অর্থাৎ সৃষ্টিকে উপকার পৌঁছানের মাধ্যমে। কখনো নিজের হক বা কখনো অন্যের হক পালনের মাধ্যমে। কখনো কায়-কারবার বা চাকুরিতে নিয়োজিত থেকে। কখনো পরিবারের মাঝে সময় অতিবাহিত থেকে। মুমিন সব জায়গায় নানান ভূমিকা নিলেও তার মূল অবস্থান ঠিক থাকবে। সেখান থেকে সে চুল পরিমাণ নড়বে না! তার মূল অবস্থান হল, সে আল্লাহ’র বান্দা, তাঁর কাছেই মুমিন সব বিষয়ে নতি স্বীকার করে – আল্লাহ পাকের স্মরণ তাকে এই শিক্ষাই দেয়, এ দীক্ষায়ই গড়ে তোলে। কবি বলেন,
যেদিন যবানে তোমার নাম নিতে শুরু করলাম
বিমোহিত হলাম
অন্তরে কী যে এক স্বাদ পেলাম!
আমার সবকিছু তখন থেকেই তোমার তরে কুরবান
যেদিকেই তাকাই তোমার নাম, তোমারই শায়ানে-শান!
এখন যা দেখি, যা শুনি, যা অনুভব করি হৃদয়-মনে-শরীরে
সবকিছুতে একই স্পন্দন,
শুধু তোমার নাম, তোমারই কলতান।
যিকিরবিহীন জীবন সত্যিই মৃত। তাই অন্তর ও আত্মাকে বেশি থেকে বেশি যিকিরে অভ্যস্ত করতে হবে। যিকিরের জন্যে সময় বের করে (মুজাহাদা অর্থাৎ) কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে তেলাওয়াত-তাসবীহ-তাহলীল করতে হবে। দৈনিক নিয়মিত এভাবে যিকিরে নিজেকে নিয়োজিত না করলে যিকিরের বরকত জাগতিক ও অন্যান্য পূণ্য কাজেও পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলাকে বিশেষভাবে স্মরণ না করে (অর্থাৎ যিকিরের জন্য পৃথক সময় না দিয়ে) কিভাবে এটা আশা করবে যে জাগতিক কাজে লিপ্ত হয়ে নিজেদের অন্তর ও মনকে খুব সহজেই আল্লাহ’র দিকে ঝোঁকাব? কবি বলেন, “মন-তন সব দিয়েছ এই সংসারকে। এখন সেজদার স্থানেও (অর্থাৎ মসজিদেও) বেএখতিয়ার এই দুনিয়ার কথা বের হয় তোমার যবানে – যেটা হওয়ার ছিল সেটাই তো হচ্ছে! বুঝে নাও তুমি কার সাথে সম্পৃক্ত, তুমি কার তরে কুরবান হে!”
এজন্যেই যেটা হয়: আমাদের দুনিয়া দ্বীনের কাজে খুব প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু আমাদের দ্বীন দুনিয়ার কাজে তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করে না।
কী করতে হবে? সেই একই কথা! খুব গুরুত্ব দিয়ে শোনার ও বোঝার আছে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ অথবা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে নিজের উপর আল্লাহ পাকের স্মরণ বা ‘যিকির’কে আবশ্যকীয় করে নিতে হবে। শুরুতে কম হোক, কিন্তু প্রতিদিন এ যিকির জারি রেখে ‘রুহ’কে খাদ্য যোগান দিতে হবে। এটাই প্রাথমিক কাজ। যদি কোনো দ্বীনি রাহবার – আল্লাহ’র পথে চলার জন্য মুরুব্বী – মুত্তাকী আলেমের কাছ থেকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা নেয়া হয়, সবচেয়ে উত্তম ও বরকতপূর্ণ। কারণ অভিজ্ঞ মানুষের পথনির্দেশ নিঃসন্দেহে কল্যাণকর হয়ে থাকে। আর তার ওপর যদি তিনি হন একজন মুত্তাকী আলেম, তাহলে তো কথাই নেই! আর যদি তা শুরুতে সম্ভব নাও হয়, কমপক্ষে হাদীসে বর্ণিত দৈনন্দিন যিকিরগুলো নিয়মিত করা দিয়েই পথ চলা আরম্ভ হোক; ইনশাআল্লাহ ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
প্রবন্ধটি দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কায় ‘দোআ’র আলোচনা সংক্ষেপে করা হচ্ছে….
আসলে ‘দোআ’ কি কোনো সংক্ষেপে আলোচনার বিষয়?! বান্দার পক্ষে রবের কাছে ‘মুনাজাত’ করার চেয়ে অমূল্য সুযোগ এ জগতে আর কী আছে?! তাও নেই কোনো বাঁধা, কোনো বিশেষ বড় কোনো শর্ত। যেকোন ঈমানদার দোআ’র মাধ্যমে সব অবস্থায় দুনিয়া ও আখেরাতের সমগ্র কল্যাণকে নিজের পক্ষে খুবই সহজে অর্জন করতে পারে। দু’আ সুমহান, অতুলনীয় ইবাদত। মুমিনের অস্ত্র। চলতে, ফিরতে, উঠতে, বসতে – সব অবস্থায় মুমিন তার মন-তনকে দোআ-মুখী রাখবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ তো সেই দোআ’রই এক বিশাল ভান্ডার উপহার দিয়েছে! তারপরও কার্পণ্য? তারপরও অবহেলা?! বান্দার কী লাগবে? কখন লাগবে? কিভাবে লাগবে? কোথায় লাগবে? কোন্ অবস্থায় লাগবে? শুধু মনোনিবেশ করুন না একটু….রব্বে কারীম, যুল-জালালে ওয়াল ইকরাম….রাব্বুল ’আলামীন, আহকামুল-হাকিমীন – আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলা’র কাছে – ‘চান’! তাঁর কুদরতের কারীশমা বোঝা ভার। বান্দা যেন চায়, চেয়ে ফেলে…সব অভিযোগ যেন তাঁর কাছেই করে। পুরো সৃষ্টিজগত এক সাথেই আল্লাহ’র কাছে আবেদন-নিবেদন করুক না! প্রত্যেকের সব প্রয়োজন একই সাথে পূরণকারী সেই সত্ত্বা – তিনিই ‘আল্লাহ’! চলতে, ফিরতে, উঠতে, বসতে, সুখে-দুখে, একা, দলাবদ্ধ – সব অবস্থায় তাঁর দিকে মন-অন্তরকে লাগিয়ে রাখার চেষ্টা করুন। যখন যা দরকার তাঁর কাছে চান, তাঁকে বলেন। দেখবেন কী অপূর্ব এক স্বাদ অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। জগতের মালিকের সাহায্যকে আপনি এত কাছে পাবেন যে তখন দুনিয়ার সব বাদশাকে পর্যন্ত একত্রে আপনার কাছে নস্যি মনে হবে!
আসুন, এই বরকতপূর্ণ সময়গুলোকে (যেহেতু এখন রমযানুল মুবারক), সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই জীবনকে আল্লাহ’র দিকে ঘুরিয়ে দেবার! কবি বলেন,
হে বন্ধু! কত কাল
….আর কত কাল বল
এই জঙ্গলে একাকী তুমি ঘুরপাক খাবা?!
এভাবে জীবন তো বিপৎসংকুল হয়ে যাচ্ছে,
এবার এঁর মালিককে খোঁজো না!
তোমার জন্যে তিনিই যথেষ্ট, ক্যান্ এ কথা বুঝ না?
সূরা হাদীদের সেই ঈমান-জাগানো আয়াতটির অংশ-বিশেষ দিয়ে যবনিকাপাত করে আমরা আল্লাহ তাআলা’র রহমতের দৃঢ় আশা করছি:
….أَلَمۡ يَأۡنِ لِلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن تَخۡشَعَ قُلُوبُہُمۡ لِذِڪۡرِ ٱللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ ٱلۡحَقِّ
অর্থ: ঈমানদারদের জন্য কি সে সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে – আল্লাহ’র স্মরণ ও যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার সামনে? (সূরা হাদীদ: ১৬)
JazakAllah,very good series, MashaAllah