চিন্তার খোরাক​

রমযানের শেষ লগ্নে চিন্তা ও প্রচেষ্টা

জীবনের স্রোত তো সঠিক ধারায় প্রবাহিত করতে হবে। তাই তওবা-ইস্তেগফার করে কার্যত তা প্রমাণ করতে হবে। যত্নসহকারে জীবনের অমূল্য সময়ের হেফাজত করতে হবে। দৈনিক উন্নতির জন্য একটি সহজ-সরল রুটিন সবার থাকা উচিত।

যে কাজগুলো করা জরুরি সেগুলো হোক জাগতিক, সেগুলোও রুটিনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অনেক জায়েয/মোবাহ কাজ আমাদের মন-মস্তিষ্ক-স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। এগুলো উত্তম নিয়তে রুটিনে রাখা যেতে পারে। অনেক কাজ আছে দ্বীনের ওপর চলতে সহায়ক। যেমন: ব্যায়াম, খেলাধুলা, উপদেশমূলক/গল্পের বই পাঠ, প্রতিদিন শখের কাজ করা প্রভৃতি। এগুলোর মাধ্যমে আমাদের মতন সাধারণ মানুষদের মনের শুষ্কতা দূর হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি ঘুম ও খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতন করা উচিত। খুব কম/বেশি ঘুমানো যেমন উচিত নয়, খুব কম/বেশি খাওয়াও ক্ষতিকর।

অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত না থাকতে পারলে গুনাহ থেকে বাঁচা যাবে না। অপ্রয়োজনীয় কাজগুলি গুনাহর ভূমিকা। আর সঙ্গ খারাপ হলে অপ্রয়োজনীয় কাজ ত্যাগ করা যায় না। এভাবেই দ্বীন-দুনিয়া নষ্ট হয়ে যায়। যত্নের সাথে সঙ্গ নির্বাচন করতে হবে। যে সঙ্গ অবলম্বন আমার দ্বীন ও দুনিয়ার জন্য বেশি উপকারি, সেগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। উত্তম সঙ্গী নির্বচন অনেক অহেতুক কাজ ও গুনাহ থেকে বাঁচার সহজ উপায়।

শুধু ব্যক্তিগতভাবেই দ্বীনদার হওয়া যথেষ্ট নয়। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, আশেপাশের মানুষের উপর চড়াও হয়ে যাবো। বরং আমাদেরকে সবরের সঙ্গে নিকটজনদের প্রতি দ্বীনি দাওয়াত পৌঁছাতে হবে। অনেকেই এ কাজটি ইসলামকে জানার প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু করে দেয়। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি যদি কিছুটা দ্বীনকে জানতে পারে, কিছু নেক কাজ শুরু করতে পারে তার পর মুহূর্তে অন্যকে বোঝানোর কাজে ঝাঁপ দিয়ে দেয়। এটি নানান সমস্যার সৃষ্টি করে। কারণ, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কিভাবে দ্বীনি পয়গাম পৌঁছাতে হয়, এর মৌলিক জ্ঞানটি তার এখনও হয়নি। প্রাথমিকভাবে কেউ যখন দ্বীনকে জানল, দ্বীনের ওপর আমল করার শখ তার জাগল, তার উচিত ইখলাসের সঙ্গে (আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য) নেক আমল করতে থাকা। অন্যকে নসিহত/উপদেশ দানে ব্যস্ত না হয়ে পড়া। ইনশাআল্লাহ তার ব্যক্তিগত নেককাজের ইতিবাচক প্রভাব অন্যদের ওপরও পড়বে।

খুব খেয়াল রাখার বিষয় হল, কেবল ইবাদতে অগ্রসর হলে চলবে না। ‘হুসনে আখলাক’ বা সচ্চরিত্র  গড়ে তোলাকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হবে। নিজেকে বিনয়ী, ধৈর্যশীল ও সহনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বড় বড় ঝগড়া, বিবাদ, ফেতনা উত্তম আখলাক প্রদর্শনের মাধ্যমেই দূর হয়। সারা দুনিয়া অন্য কাউকে জঙ্গি বললেও দেখবেন, প্রিয় নবীজি ﷺ এর সুমহান আখলাক অনুসরণের বরকতে মানুষ আপনাকে কখনোই এ জাতীয় কথা বলবে না। আপনার বিরুদ্ধে এ জাতীয় কোন অভিযোগ আপনার শত্রুরা (যারা খুব কাছ থেকে আপনাকে চেনে) পর্যন্ত গ্রহণ করবে না। কারণ, শুধু নেতিবাচক কিছু শব্দ দিয়ে চিরসত্যকে কখনো ঢাকা যায় না।

আজ (আমাদের অধিকাংশ) মুসলমানদের এত অধঃপতন কেন? চিন্তা করলে বোঝা যায় তার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। দায়ী আমাদের ধারণা, বিশ্বাস ও কার্যাবলী। আমরা এখনও ভালো ঈমানদার হতে পারিনি। না হতে পেরেছি ভাল আমলকারী। হুসনে আখলাক বা সচ্চরিত্র গঠনের জন্য আমাদের কোনো প্রকার সাধনা নেই। ইবাদত, মৌখিকভাবে অন্যকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান, ধর্মীয় কিছু বিষয়ে খুব দৃঢ় অবস্থান নেওয়াকে আমরা মনে করেছি দ্বীনের ওপর চলা। অথচ ইবাদতের পাশাপাশি উত্তম আখলাক গঠনই একজন মুসলমানকে প্রকৃত ‘মুসলিম’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এ অস্ত্রটি কতই না উত্তম! বিনাযুদ্ধে যার মাধ্যমে ইসলাম এতদূর এসেছে, কিন্তু আফসোস! এ অস্ত্রটি আজ বিজাতীয়রা তুলে নিয়ে দুনিয়াতে তাদের জয়জয়কার প্রদর্শন করছে। আর আমরা আমাদের এ সম্পদ হারিয়ে আজ সেই কাফেরদের খেল-তামাসার বস্তুতে পরিণত হয়েছি। এরই ফলস্বরূপ ‘জঙ্গি’ আর terrorist বলে আমাদেরকে গালি দিলে আমরা স্বপক্ষে কিছু বলতে পারছি না। কারণ আমাদের আদব, ইবাদতের অবস্থা ও আখলাক/চরিত্র ইসলামের গন্ডির থেকে অনেক দূরে সরে গেছে! প্রিয় নবীজি ﷺ এর পবিত্র সীরাত পড়ুন। গভীরভাবে অধ্যয়ন করুন। চোখ খুলে যাবে ইনশাআল্লাহ। সাহাবায়েকেরাম رضي الله عنهم এর পুতঃপবিত্র জীবনী দেখুন। আন্তরিকভাবে পাঠ করলে নিজের দুরাবস্থা নিজের কাছে প্রকাশ পাবে ইনশাআল্লাহ। ইসলামের আলোকে আত্মসংশোধন ও আত্মোন্নয়নের সিঁড়িতে পা রাখা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ!

আর যে বিষয়টি আমাদের অনেক বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে তা হল, সঠিক ইসলামী জ্ঞান সঠিকভাবে অর্জনের অভাব। দ্বীনি ইলম তথা ইসলামের জ্ঞান অর্জন না করলে আকীদা, ইবাদাত, আখলাক, মুয়ামালাত ও মুয়াশরাত কিছুই ঠিকমতন গড়ে ওঠে না। একজন মুসলমানের জীবন গঠন করা কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই এ বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। আলেমে দ্বীন যারা, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কুরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান দান করেছেন, তাদের কাছে গিয়ে দ্বীনি তথা ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। না হলে, মন-মস্তিষ্ক অন্যসব জ্ঞানে প্লাবিত হলেও ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝবে না। অন্তরে ইসলামের প্রকৃত নূর বা আলো জ্বলবে না। এতে ঈমান ও নেক আমলের কোনোটিই কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী গঠিত হবে না। শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির অনুসরণে এক বিকৃত ধর্মকে আমরা ঈমান ও ইসলাম বলে গ্রহণ করে ধ্বংসের গহ্বরে পড়ে যাব। আত্মসংশোধন, পরিবার ও সমাজ জীবনে ইসলামের চর্চা,  দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক সফলতা অর্জনের জন্য আমাদের সবাইকে আবশ্যকীয় পরিমাণ দ্বীনি জ্ঞান অর্জনে অত্যন্ত যত্নবান হতে হবে।

রমযান শুধুমাত্র তাকওয়ার কথা স্মরণ করাতে আসেনি। এসেছে তাকওয়াকে মুমিন জীবনে বৃদ্ধি ও বাস্তবায়ন করতে। এটি বিস্মৃত হয়েই আমাদের আজ এ করুণ দশা। রোযা রাখা আর তারাবীহর মধ্যে আমাদের রমযান সীমাবদ্ধ করেছি। ঈদের প্রস্তুতি আর ছুটি কাটানোর চিন্তা নিয়ে অমূল্য সবটুকু সময় নিঃশেষ করে ফেলছি আমরা। একটি ঈদের দিনের জন্য যদি এত প্রস্তুতি লাগে, তাহলে চিন্তা করুন দীর্ঘ এক মাসব্যাপী রমযানের জন্য প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত ছিল?!

এখন ‘তওবা’ অর্থাৎ আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার সময়। রমযানের যথাযথ হক তো আদায় হল না। এখন আন্তরিকভাবে তওবা করে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধের অনুগত হয়ে চলার চিন্তা ও প্রচেষ্টায় নেমে পড়তে হবে। হে আল্লাহ আপনি তাওফীক দিন। আমীন।

Last Updated on February 4, 2023 @ 8:55 am by IslamInLife

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it