আলী ইবনে আবী তালিব রাযিআল্লাহু আনহু (মৃ. ৪০ হিজরী : ৬৬১ খৃস্টাব্দ)

অশ্বারোহী মুজাহিদ। ইসলামের আলোকিত উপহার। ইতিহাসের সেরা জন্ম। ঈমানের শয্যায় বিচরণকারী এক ব্যক্তিত্ব। নবীজীর সাথে তাঁর হৃদ্যতা ছিল মূসা ও হারূনের হৃদ্যতা। ইসলামের পাঠশালায় তিনিই প্রথম ছাত্র। ছেলেবেলায় খেয়েছিলেন ঈমানের সমীরণ। তাজা ও সজীব ওহীর সৌরভ গ্রহণ করেছিলেন তৃপ্তি মিটিয়ে। নবী-রাসূলদের চরিত্রের ন্যায় তাঁর আখলাক-চরিত্র ছিল। তিনি হলেন আলী ইবনে আলী তালিব। নবী ﷺ-এর চাচাতো ভাই ও জামাতা। চতুর্থ খলীফা রাশেদ। নবুওতী আদলে পরিচালিত ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার শাসক চতুষ্টয়ের তিনি একজন। ওহীর সংবাদ তাঁরা দশজন জান্নাতী। তিনি তাঁদেরই একজন। নবুওতের দশ বছর পূর্বে তাঁর জন্ম। বাল্যকাল কেটেছে খেলাধুলা ছাড়া। পৌত্তলিকতা ও মূতিপূজার কাদা ও পাঁক-পঙ্কিলতার গহ্বরে পড়তে হয়নি তাঁকে। ইসলামের সুশীতল ছায়া গ্রহণে আমতা আমতা করেননি। ঈমানের নূরে তাঁর দু’চোখ অনায়াসেই খুলে গিয়েছিল।
মহানবী ﷺ-এর তত্ত্বাবধানে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। নবুওতের প্রত্যক্ষ আবহে লতিয়ে ছিলেন। ওহীর ছায়াতলে থেকে বড় হয়েছিলেন। তাঁর শিরা-উপশিরায় ধ্বনিত হয়েছিল মুক্তির বাণী। তিনি একাগ্রচিত্রে কান পেতে শোনেছিলেন সেই মর্মবাণী। মন ও মানসপটে শিকড়িত হয়েছিল মহান আল্লাহ তাআলার প্রেম-ভালোবাসা। স্বচ্ছ আখলাক-চরিত্র পল্লবিত হয়েছিল। যার পূর্ণতা পেয়েছিল মহানবী ﷺ-এর মোবারক হাতে। তাঁর ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি ছিল মহান একটি নমুনা।
হৃদয়গ্রাহী মন-মননে এবং উপলব্ধ আত্মা নিয়ে কুরআন গ্রহণ করেছিলেন। সেই সাথে বেড়ে তারুণ্য লাভ করেছিল ঈমানের শক্তি। যা মন ও মানসে বদ্ধমূল হয়ে হৃদয়ে পূর্ণতা লাভ করেছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বে বংশীয় কৌলীন্যের সাথে ওহীর স্বচ্ছতা সংযোজিত হয়েছিল। হিজরতের রজনীতে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা আর পর্বতসম মনোবল নিয়ে মহানবী ﷺ-এর শয্যায় শায়িত ছিলেন।
মহানবী ﷺ তাঁকে মনোনীত করেছিলেন ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করতে। ছেলেবেলায় মহাকঠিন ও কষ্টকর কাজও সাধন করেছিলেন সাহসের বলে। কোন অবস্থায় মনোবল হারাননি। চ্যালেঞ্জের মুখে দৃঢ়তা আরও শক্তি সঞ্চার করেছিল। মহানবী ﷺ-এর সকল সমর অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সিংহের ন্যায়। অধিকাংশ দুঃসাহসিক অভিযানের সময় পতাকা করতলগত করতে পেরেছিলেন। তরবারির আঘাতে কেল্লার পর কেল্লা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। যাকেই চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তাকেই পরাস্ত করেছিলেন। তাঁর তরবারির জোরে রাসূলের বহু সমস্যা তিরোহিত হয়েছিল। দেখতে সুন্দর ছিলেন। চরিত্রে ছিলেন অমায়িক, মধুর ও বন্ধুসুলভ।
দিগন্ত-বিস্তৃত রাজ্যের মুসলিম শাসক হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন। তালি তো থাকতোই। এক কাপড়েই জীবনযাপন করতেন। জীর্ণ থেকে জীর্ণ হওয়া পর্যন্ত কাপড় পরতেন। পুরনো ও জীর্ণ ছেঁড়া কাপড় পরিধান করে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী রা. বসে আছেন। মুখে ঠোঁটে আল্লাহ তাআলার যিকির ও তাসবীহ। তাঁর কাছে আসল আবূ মারইয়াম নামের আযাদকৃত একজন লোক। হাঁটু গেড়ে বসে নিঃশব্দে বলল, আমীরুল মুমিনীন, আপনার সাথে একটু দরকার আছে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় তিনি বললেন, বলো কী বলবে। কী তোমার প্রয়োজন? আবূ মারইয়াম বলল, আপনি এই জীর্ণ ছেঁড়া চাদরটা ফেলে দিন। এ কথা শোনে হযরত আলী রা. চোখে চাদরের আঁচল দিয়ে কাদতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। আবূ মারইয়াম বিব্রত অবস্থায় বললেন, আমীরুল মুমিনীন, আমার কথায় আপনার যে অবস্থা হয়েছে তা যদি আগে বুঝতাম কখনও আপনাকে এমনভাবে পরিহিত চাদর ফেলে দিতে বলতাম না।
হযরত আলী রা. থেকে উদ্ভাসিত হল শিক্ষা। কপোল বেয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ছে। তিনি বললেন, আবূ মারইয়াম, এই চাদরের প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হযরত উমর রা. এটা আমাকে উপহার দিয়েছেন। এ কথা বলে তিনি আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দূর থেকে শোনা গেল সেই চাপা কান্নার আওয়াজ।
মহানবী ﷺ দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হযরত আলী রা.কে যেভাবে রেখে গেছেন পরবর্তীতে দুনিয়া তাঁর হালত পরিবর্তন করতে পারেনি। তাইতো তিনি দিন কি দিন বছরের পর বছর মোটা খসখসে কাপড় পরিধান করে কাটিয়েছেন জীবনপ্রবাহ। একদিন তপ্ত বালিকণায় গরমে খইফুটা অবস্থায় বাইরে গেলেন হযরত আলী রা.। দেখা করলেন নিজের সাথীবর্গের সাথে। গায়ে ছিল সেই মোটা খসখসে কাপড়। রয়েছে তালির ছাপ।
সঙ্গী-সাথীরা করুণা করে বলল, আমীরুল মুমিনীন! এর চেয়ে কোমল ও পাতলা একটা কাপড় কেন আপনি নিলেন না? তিনি বললেন, এই জামা আমার আত্মগরিমা দূর করে। নামাযে আমাকে বিনয়ী হতে সাহায্য করে। লোকজনের জন্য এটা মহৎ অনুকরণীয় আদর্শ। এতে লোকজনও অপচয় আর অসার আত্মশ্লাঘায় লিপ্ত হবে না। এরপর তেলাওয়াত করলেন : تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ()
এটা পরকালের সেই আবাস যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্য যারা এই পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য। (সূরা কাসাস, আয়াত : ৮৩)। শীতের হিমেল হাওয়ার তীব্রতায় হযরত আলী রা. বসে বসে কাঁপছেন। তাঁর গায়ে জীর্ণ পুরনো চাদর। জনৈক ব্যক্তি বলল, আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তাআলা আপনি ও আপনার পরিবার-পরিজনের জন্য এসব ধনসম্পদে হিস্যা রেখেছেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আপনি প্রয়োজন অনুসারে অর্থকড়ি গ্রহণ করতে পারেন। অথচ আপনি নিজের ব্যাপারে কষ্টসাধ্য পথ গ্রহণ করছেন এবং আপনি দেখতেও পাচ্ছেন যে, শীতে আপনার হাত-পা কাঁপছে। হযরত আলী রা. বললেন, কসম, আমি তোমাদের (জনগণের) কোন অর্থকড়ি গ্রহণ করবো না। যে পুরনো ও জীর্ণ চাদর পরিধান করে আমি মদীনা শরীফ থেকে বের হয়েছিলাম এটা সেই চাদর।
সোনার ঔজ্জ্বল্য আর স্বর্ণমুদ্রার ঝনঝনানি তাঁর মানসপটে প্রবেশ করতে পারেনি। যাহেদ ও দুনিয়া বিমুখ হয়ে জীবনযাপন করেছেন। নিঃস্ব ও সম্বলহীন অবস্থায় দুনিয়া ছেড়ে পরলোক গমন করেছিলেন। একবার তিনি মদীনা শরীফের বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য নিজের তরবারি বিক্রি করা। ক্ষীণ আওয়াজে তিনি বলতে লাগলেন, এমন কেউ আছো যে আমার থেকে এই তরবারি কিনবে? ঐ সত্তার কসম, যিনি উদ্ভিদ জন্মান, আমি এই তরবারি দিয়ে রাসূল ﷺ-এর অনেক বিপদাপদ দূরীভূত করেছি। সামান্য তহবন্দ কেনার মতো অর্থকড়ি থাকলে আমি এটা বিক্রি করতাম না।
হযরত আলী তনয় (আল-) হাসান রা. তাঁর ছেলে বলেন, তিনি হাদিয়ার সাতশত দিরহাম ছাড়া অন্য কোন হলদে ও সাদা (স্বর্ণমুদ্র বা রৌপ্যমুদ্রা) কোন কিছুই রেখে যাননি। তা দিয়ে পরিবারের জন্য একজন কাজের লোক নেওয়া তাঁর ইচ্ছা ছিল।
খরচের তোড়ে দুনিয়া মাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সম্পদ তাঁর কাছে উপলক্ষ্য ছিল; লক্ষ্য ছিল না। অর্থকড়ি তাঁর নিকট সেবক হয়ে ছিল; মোড়ল হয়ে নয়। দারিদ্র্য-পীড়িত দুর্বল ও ক্ষীণ এক শরীর। প্রয়োজনে শীর্ণ ও জীর্ণ। অভাব-অনটন-নিষ্পেষিত কঠিন অবস্থায় আরেক দরিদ্র ব্যক্তি হাজির, আহার্য চাচ্ছেন হযরত আলী রা.-এর কাছে। হযরত আলী রা. তাঁর ছেলে হাসানকে বললেন, তোমার আম্মার কাছে গিয়ে বলো, আব্বু আপনার কাছে যে ছয় দিনার রেখেছেন সেখান থেকে এক দিনার দিতে বলেছেন। হযরত হাসান রা. গিয়ে ফিরে এলেন। বললেন, সেই ছয় দিনার তো আটা খরিদ করার জন্য রেখেছেন। হযরত আলী রা. বললেন, কোন বান্দার ঈমান পূর্ণতা পাবে না যে পর্যন্ত সে খোদার কাছে যা আছে তার প্রতি নিজের সহায়-সম্বলের চেয়ে বেশি আস্থাশীল না হবে।
এরপর তিনি বললেন, তোমার আম্মুকে বলো সেই ছয় দিনার আমার কাছে পাঠাতে। অবশেষে তিনি সেই ছয় দিনার পাঠালেন। ভিক্ষুককে ছয় দিনার দিয়ে বিদায় করলেন। এরই মধ্যে হযরত আলী রা. নিজের আসন থেকে উঠতে না উঠতেই একজন তাঁর পাশ দিয়ে অতিক্রম করলো। সাথে একটা উট। সে উটটি বিক্রি করতে চায়। হযরত আলী রা. সেই উটটি বাকিতে একশত চল্লিশ দিরহাম দিয়ে খরিদ করলেন। যা (ষাট দিরহাম লাভে) দুইশত দিরহামে বিক্রি করেছিলেন।
এরপর হযরত আলী রা. বললেন, মহানবী ﷺ-এর মোবারক জবানিতে আল্লাহ তাআলা আমাদের সাথে এই ওয়াদা-ই করেছেন। কেউ যদি একটি নেকির কাজ করে তার জন্য অনুরূপ দশটি নেকির প্রতিশ্রুতি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন: مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا ‘কেউ কোন সৎকর্ম করলে সে তার দশ গুণ পাবে।’ (সূরা আনআম, আয়াত : ১৬০)।
হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা. এক খণ্ড- জমি কিনলেন। পরে সেখানে পানির জন্য কূপ খনন করতে বললেন। লোকজন খনন করতে ব্যস্ত, এরইমধ্যে ভূ-গর্ভ থেকে মিঠে সুপেয় ঠাণ্ডা পানির প্রস্রবণ উৎসারিত হতে শুরু করল। উথলে উঠা পানির ঝর্ণা দেখে লোকজন দৌড়িয়ে হযরত আলী রা.কে সুসংবাদ দিতে লাগল। এতে তিনি বিনয়াবনত হয়ে মাথা নিচু করে ক্ষীণ স্বরে বলতে লাগলেন, কেমন যেন তিনি মনে মনে কথা বলছেন, এতে পরবর্তী উত্তরাধিকারী লোকদের জন্য সুবিধা হবে।
পরক্ষণে তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, উপস্থিত যাঁরা আছেন আপনাদের বলছি! আল্লাহ তাআলা সাক্ষী এবং আপনাদের সাক্ষী রেখে বলছি, এই জমিনের প্রস্রবণ জমিসহ দরিদ্র ও মিসকীন লোকদের জন্য আল্লাহ ওয়াস্তে দান করে দিলাম।
হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর মজলিসে হাড় জিরজেরে এক লোক প্রবেশ করল। কঙ্কালসার সেই লোকটির কপালটি উঁচু এবং চোখগুলো কোটরগত। সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে তার দারিদ্র্য ও অভাব-অনটনের রেখাগুলো। তালি দেওয়া জামা পরিহিত লোকটির শরীরের অবয়ব সহজেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। লজ্জা বিজড়িত কাঁপা ঠোঁটে সে বলল, আমীরুল মুমিনীন! আপনার সাথে আমার একটু দরকার আছে। অবশ্য সেই প্রয়োজনটা আপনার আগে আল্লাহ তাআলার দরবারে আরজ করে এসেছি। এখন আপনি যদি পূরণ করে দেন আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করবো এবং আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। আর যদি আপনি সেই প্রয়োজনে সাড়া না দেন তাহলে আল্লাহ তাআলার তারিফ করবো এবং আপনাকে অপারগ মনে করবো।
হযরত আলী রা. লজ্জা ও আদব রক্ষা করে বললেন, মাটিতে লিখে দিন কী আপনার প্রয়োজন। আপনার প্রয়োজনের একটি অপমানজনক বলিরেখা চেহারায় দেখতে আমার ভারি অপছন্দ। লোকটি মাটিতে লিখে দিল, ‘আমি অভাবী’। আলী রা. উচ্চস্বরে বললেন, এক সেট জামা নিয়ে এসো। লোকটি জামা গ্রহণ করল। তিনি তাকে অতিরিক্ত একশত স্বর্ণমুদ্রা দিলেন।
সবসময় এবং সর্বাবস্থায় তিনি নিজের অর্থকড়ি বিলাতেন। রাতের অন্ধকার এবং সূর্যের কাঠফাটা রোদ যা ব্যাহত করতে পারতো না। মিম্বরের কাছে বসে আছেন আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রা.। তিনি চাদর পরিহিত। কুরআনের আয়াত হৃদয়ে আওড়াচ্ছেন। এক লোক এসে জিজ্ঞেস করলো, ইবনে আব্বাস! কুরআনের এই আয়াতটি কার ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল? الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً ‘যারা নিজেদের ধনৈশ্বর্য রাতে ও দিবসে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে…(সূরা বাকারা, আয়াত : ২৭৪)। তিনি বললেন, আয়াতটি হযরত আলী রা. ব্যাপারে নাযিল হয়েছিল। তাঁর কাছে চার দিনার ছিল। তিনি রাতে এক দিনার, দিনে এক দিনার, গোপনে এক দিনার এবং প্রকাশ্যে এক দিনার খরচ করেছিলেন।
তিনি ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন সামান্য শুষ্ক খাবার খেয়ে। সুস্বাদু ও কোমল খাবার পাকাশয়ে যায়নি। দ্বিপ্রহরে (বাগদাদ নিকটবর্তী শহর) ‘আকবরা’র কর্মকর্তা হযরত আলী রা.-এর দরবারে এসে হাজির। এসে হযরত আলী রা.-এর দরজার সামনে কোন দারোয়ান পায়নি। অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। দেখে, হযরত আলী রা. দু’হাত পরিবেষ্টিত দু’হাঁটু তুলে বসে আছেন। তাঁর সামনে পেয়ালা ও গ্লাস ভর্তি পানি। সেখানে রাখা আছে একটি ছোট থলে। লোকটি মনে মনে ভেবেছিল, আমীরুল মুমিনীন হয়তো আমার আমানত ও বিশ্বস্ততার ইনাম দিবেন। মণিমুক্তা বা উৎকৃষ্ট কোন সামগ্রী আমাকে দিতে পারেন। আলী রা. থলে খুলে দেখালেন। তাতে ছিল রুটির সামান্য টুকরা। সেই টুকরাগুলো পেয়ালায় রেখে সামান্য পানি ঢাললেন। পরে বললেন, আসো আমার সাথে খাও। লোকটি বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলল, আমীরুল মুমিনীন! আপনি ইরাকে থেকে এমন করছেন ? ইরাকের খাবার এর চেয়ে অনেক বেশি। হযরত আলী রা. অতি বিনীত হয়ে বললেন, কসম খেয়ে বলছি, শোন, এসব রুটির টুকরোগুলো মদীনা শরীফ থেকে আগত। আমি চাই না পবিত্র কিছু ছাড়া অন্য কিছু আমার উদরে প্রবেশ করুক।
তিনি যথাযথ তাকওয়া ও পরহেযগারি মনের অধিকারী ছিলেন। একবার হযরত আলী রা. এর আযাদকৃত গোলাম ‘কুম্বর’ দৌড়িয়ে আসলেন। শুভানুধ্যায়ী হয়ে বললেন, আমীরুল মুমিনীন ! আপনার কাছে তো সঞ্চিত কোন কিছু নেই। হয়তো এ অবস্থায় আপনি পৃথিবী থেকে চলে যাবেন। অথচ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আপনার পরিবার-পরিজনের হক ও হিস্যা রয়েছে। আমি আপনার অগোচরে কিছু সম্পদ সঞ্চিত করে রেখেছি। এ কথা শোনে হযরত আলী রা. থ বনে গেলেন। বললেন, কী সেই সঞ্চিত সম্পদ? কুম্বর বলল, তাহলে আমার সাথে আসেন। দু’জন চলতে চলতে ছোট একটি ঘরে প্রবেশ করলেন। গিয়ে দেখেন, বড় গোলার ন্যায় একটি সেলাই করা চাদর দেয়ালের মূলে রাখা। হযরত আলী রা. নিজে সেটি খোলেন। দেখলেন, চাদরটি সোনা-রুপার পাত্র ও তৈজসপত্রে ভরা। কুম্বরের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ধুত্তোর! তুমি তো আমার ঘরে ভয়াবহ আগুনের কারবার করে ফেলেছিলে! এরপর তিনি সেগুলো খুলে লোকজনের মাঝে বিতরণ করে দিলেন। বিতরণ শেষে গুনগুন করে বললেন, (হে তৈজসপাত্র) যাও অন্যের বাড়িঘর আলোকিত করো।
হিজরী ৪০ সালের ১৭ রমাযান ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম কর্তৃক অতর্কিত হামলার শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। শাসনকাল ছিল ৪ বছর ৯ মাস ৮ দিন।

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it