আখলাক ও আত্মশুদ্ধি

আত্মসংশোধন কি, কেন ও কিভাবে-২

আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য কোনো খাঁটি আল্লাহওয়ালার নেক সুহবতের (সঙ্গের) কোনো বিকল্পই নেই। তাদের সুহবত যদি সরাসরি সার্বক্ষণিক নাও জুটে তবে তাদের লিখিত কিতাব বা উপদেশ/কথা পড়লে বা রেকর্ড করা উপদেশ/বয়ান শুনলেও আল্লাহ তাআলার ফযলে অনেক উপকার হয়। বরং আল্লাহওয়ালাগণ বলেছেন যে, তাদের সুহবত অর্জনের জন্য বিকল্প এক পন্থা হল তাদের কিতাবাদি পাঠ, উপদেশ ও বয়ান শোনা। আরবের এক আল্লাহওয়ালা (নাম ভুলে গেছি) ঈদের দিন একাকী হযরত সাহাবায়েকেরাম رضي الله عنهم –দের জীবনী বিষয়ক কোনো বই পড়ছিলেন। আরেক হযরত তার সাক্ষাতে এসে বললেন, “হযরত! ঈদের দিন সবাই যখন আনন্দ ফুর্তি করছে – আপনি একাকী এখানে কি করছেন?” কিতাব পাঠরত আল্লাহওয়ালা জবাব দিলেন, “আরে আমি একা কোথায়? আমিতো নবীজি ﷺ-এর সাহাবা رضي الله عنهم -এর পবিত্র সুহবতে রয়েছি।”

সুহবতের বা সঙ্গের বিস্ময়কর প্রভাব রয়েছে এবং তা অনস্বীকার্য। ভালোভাবে তা উপলব্ধি করা দরকার। সৎসঙ্গের প্রভাব যেমন সৎ, নেককার ও ভালো মানুষ বানিয়ে দেয়। ঠিক একইভাবে অসৎ সঙ্গ তার বিপরীতে মানুষকে অসৎ বানায়, নানান ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এজন্যই আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, যার অর্থ: “তুমি মানুষের কথা জানতে চেও না – জানতে চাও তার বন্ধু সম্পর্কে।” অর্থাৎ, কারো বন্ধুর স্বভাব, চরিত্র আর অভ্যাসই তোমাকে বলে দেবে সেই ব্যক্তি আসলে কেমন। কারো বন্ধু যদি সচ্চরিত্রবান, ভালো অভ্যাসের অধিকারী হয়ে থাকে – আশা প্রবল যে, তার মধ্যেও সেই গুণ বিদ্যমান। আর যদি তার বন্ধুই খারাপ মানুষ হয়, মন্দ স্বভাব বিশিষ্ট – তো আশঙ্কা আছে যে, সেই লোকও ভালো নয়।

আন্তরিকতার সাথে ভালো মানুষের সাথে চললে তার ইতিবাচক প্রভাব জীবনকে ধন্য করে দিবে ইনশাআল্লাহ। ভালো মানুষ বলতে কুরআন ও হাদীসের ভাষায় মুত্তাক্বী – পরহেযগার। যত্ন সহকারে যারা আল্লাহ তাআলার হুকুমের পাবন্দ – অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার আদিষ্ট কাজে রত এবং যে কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত। তিনি একদম ফেরেশতা হবেন – তা নয়, মানুষই। তারও ভুল-ত্রুটি হয়। কিন্তু তিনি আল্লাহ তাআলার পথে কঠোর সাধনাকারী। আত্মশুদ্ধির পথে অনেক অগ্রসর। আল্লাহ তায়ালার ভয় তার অন্তরে প্রবল। আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা তার অন্তরে প্রবল। সুন্নতের অনুসরণে অর্থাৎ, রাসূলে আকরাম ﷺ-এর সুন্নতের প্রতি খুবই সজাগ ও যত্নবান । এরকম দশটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা থানভী رحمة الله عليه তার ছোট্ট কিন্তু অতীব মূল্যবান ‘কাসদুস সাবীল’ বইটিতে। হ্যাঁ, খাঁটি আল্লাহ ওয়ালা সনাক্ত করার জন্য দশটি গুণ। এক কথায়, ‘মুত্তাক্বী’ – পরহেযগার চেনার পয়েন্ট বলা যায়।

আর হ্যাঁ, “ইসলাহী মাজালিস” বইটি আজই সংগ্রহ করুন। বিস্ময়কর একটি বই! বইটি ৬ খন্ডে প্রকাশিত। মূলত উর্দুতে। বাংলায় ৩ খন্ডে প্রকাশিত ও সমাপ্ত হয়েছে – হ্যাঁ, প্রতি খন্ড উর্দুর দুই খন্ড সম্বলিত।  প্রথম খন্ডের প্রথম মজলিসে বইটির ভূমিকা পড়লে ইনশাআল্লাহ বইটির গুরুত্ব বুঝে আসবে। বরং, তাযকিয়া, তাসাওউফ এবং পীরী মুরীদি – আসলে কি? এর উদ্দেশ্য ও হক সীমানা সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা হবে ইনশাআল্লাহ।

অনেকেই পীরী-মুরীদি বিষয়টির বাজারি কর্মকান্ড দেখে হতাশ, স্বাভাবিক। কারণ, যারা ভন্ড, পথভ্রষ্ট তাদের কাজকর্ম, আকীদা বিশ্বাস নিঃসন্দেহে ভ্রষ্টতা। কিন্তু আত্ম-সংশোধন, তথা “তাযকিয়া” তো কুরআন-এর শব্দ। উম্মত তো ১৪০০ বছরের বেশি ধরে বুযূর্গানে দ্বীনের ধারাবাহিকতায় এই সঠিক পীরী-মুরিদী চর্চা করে আসছে। কেউ যদি এই বিষয়ে সঠিকভাবে জেনে নেয়, তাহলে এই বিষয়ে ভন্ডদের বিপরীতে সে এক বিশাল হক্বপন্থী জাম’আত দেখে বিস্মিত হবে। হ্যাঁ, তাও একেবারে নবীজি ﷺ-এর জামানা থেকে আজ পর্যন্ত উনাদের কেউ-ই তো কবর পূজা, মাজার কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান, পীর সাহেব-কে সিজদা — ইত্যাদি জঘন্য কাজে নিয়োজিত ছিল না। বরং এই আত্মশুদ্ধির পথ সরাসরি কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সাহাবায়ে কেরাম رضي الله عنهم -এর সংশোধন নবীজি ﷺ এর পবিত্র সঙ্গ দ্বারা হয়েছে এবং সেই সঙ্গটি অতুলনীয় বলেই সাহাবী رضي الله عنهم -গণও হয়েছেন অতুলনীয়। পরবর্তী উলামায়ে কেরাম, বুযুর্গানে দ্বীন এই পথ অনুসরণ করাকেই আত্মসংশোধন তথা তাযকিয়ার মূল চাবিকাঠি সাব্যস্ত করেছেন – কোনো খাঁটি আল্লাহওয়ালা (মুত্তাকী তথা পরহেযগার)-র সঙ্গ -যিনি নিজেও কোনো আল্লাহওয়ালার সঙ্গ লাভে জীবনকে শরীয়তের আমলে অভ্যস্ত হয়েছেন।

পীর-মুরীদির বাজারি কর্মকান্ড দেখে হতাশ হয়ে আজ যারা তাসাওউফ তথা তাযকিয়া বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে, তাদের কাছে শুধু এতুটুকু অনুরোধ, অবশ্যই মাওলানা আশরাফ আলী থানভী رحمة الله عليه রচিত “ইসলাহী নিসাব” বইটি পড়ুন। ইনশাআল্লাহ বুঝতে পারবেন, কুরআন ও আহাদীস “তাযকিয়া” বলতে কি বুঝিয়েছে, আর ভন্ড, স্বার্থান্বেষী মানুষেরা সেটাকে বিকৃত করে – কি রূপ দিয়েছে; হকপন্থী উলামারা কিভাবে সংশোধন তথা আত্মশুদ্ধির কথা বলেন, আর মাজার-পূজারী, পীর-সিজদাকারী ও শিরক-বেদআতী-রা কোন পীর-মুরীদির কথা বলে।

আসলে দ্বীনের যেকোনো কাজই যখন প্রান্তিকতা তথা বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির শিকার হয়, তখনই বিভ্রান্তি, পথভ্রষ্টতা ইত্যাদির হুমকি আসে। সর্বসাধারণ যদি তাদের মতনই মানুষদের কাছে দ্বীন তথা ইসলামী বিষয় জানতে থাকে তাহলে আর পবিত্র কুরআন ও আহাদীসকে গভীর ভাবে চর্চাকারী উলামাগণের কি দরকার!

আজ আমাদের হয়েছে এই দশা। আমরা ইসলামকে জানার আগ্রহ করেছি; কোনো সাধনা ছাড়া, শুধু বইপত্র, মিডিয়া – ইত্যাদির মাধ্যমে যত্রতত্র ইসলাম শিখছি। ইসলামের সবক নিচ্ছি – যাকে দেখে একটু ভালো লাগছে – তার থেকেই। নিজেই তৈরি করে নিচ্ছি নিজের ইসলামের শিক্ষানীতি। এটা অনধিকার চর্চা ব্যতীত আর কিছুই নয়। ইসলামকে সঠিকভাবে জানার জন্য সঠিক নিয়ত, তলব ও দোআ অত্যাবশ্যক। উলামাদের কাছে যাওয়া জরুরি। তাদের কাছে মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, খেয়াল, ধারণা, নিজের দ্বীনি জ্ঞান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা জরুরি। তাদের কারো আচরণে যদি মনে কষ্টও লাগে – মনে রাখবেন, সব ডাক্তার একরকম মেজাজের নন। আপনি ডাক্তারের নেতিবাচক কোনো আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে চিকিৎসা-তো বন্ধ করাবেন না।

আমরা যেটা আজ সাধারণত করে থাকি, তা হল, অল্প সময়েই কারো সম্পর্কে “মন্তব্য” করে ফেলি। এটা ঝুঁকিপূর্ণ পথ। একজনকে দেখে অনেক সময় সেই জামআতের সবাই-কে মন্দ বলে ফেলি। এটা মূর্খতা ও বোকামি।

দ্বীনি ইলম-এর প্রাথমিক স্তরই যারা উত্তীর্ণ করেনি, তারা যদি ইলম ও উলামাদের নিয়ে যত্রতত্র আলোচনা ও মন্তব্য করতে থাকে, তাহলে সর্বপ্রথম সেই ব্যক্তি নিজে আল্লাহ তাআলার গোস্বা ও শাস্তিতে পতিত হবে। মন্তব্য, বিচার-বিবেচনাতো সমকক্ষ মানুষ করবে। হ্যাঁ, অন্তরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, প্রশ্ন ইত্যাদি উদ্রেক হলে, সরাসরি সেই ব্যক্তিকেই জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে – যার প্রতি আমার এমন ধারণা। অথবা অন্য কোনো সৎ উপায় অবলম্বন করেই সত্য উদঘাটন করতে হবে।

তাযকিয়া, তাসওউফ, আত্মশুদ্ধি – এই বিষয়টি নিয়ে এত প্রসিদ্ধ বই – আরবী, ফারসী, উর্দু – ভাষায় রয়েছে – সর্বযুগের এমন সব ব্যক্তিগণ সেগুলির রচয়িতা – তাদের প্রতি সন্দেহ, মন্দ ধারণা ইত্যাদি যদি (আল্লাহ মাফ করুন) থেকেই থাকে, তার জন্য আমরা একদম গা-ছাড়া ভাব করে বসে থাকব? তাহলে কি আদৌ আমার নিজের সংশোধন সম্ভব? উনারা কি মুসলমান ছিলেন না? আর মুসলমানের প্রতি কি কুধারণা করা যায়?

এমন বড় বড় ব্যক্তিত্ব, যারা শুধু মুসলমান-ই ছিলেন, এমন নয়। যাদের পবিত্র জীবনী লিখিত ও সংরক্ষিত রয়েছে। তাদের জীবন “কেমন পবিত্র ছিল” তার সাক্ষী এত অধিক – যে তারপর তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো সন্দেহ করাও বিস্ময়কর ও আপত্তিকর। এতটুকুও না বললেই নয়, ঈমান ও ইসলাম আমরা কোনো না কোনোভাবেই তাদের মাধ্যমেই পেয়েছি। কিন্তু হায়! আজ আমাদের দু:সাহস দেখলে শুধু অবাকই হতে হয়, আমরা তাদের বিষয়ে যত্রতত্র মন্তব্য করি।

আত্মশুদ্ধির জন্য এটাতো একেবারে প্রাথমিক শর্তগুলির অন্যতম যে, সর্বযুগের উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে-দ্বীন সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করে নিয়ে আন্তরিকতার সাথে অগ্রসর হতে হবে।

Last Updated on November 20, 2023 @ 7:37 am by IslamInLife

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: you are not allowed to select/copy content. If you want you can share it